বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক ‘শিক্ষা দিবস’। শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ, বিজয়, গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই শিক্ষা দিবসের এবার ৫০তম বার্ষিকী।
১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক আইয়ুব খান তৎকালীন শিক্ষা সচিব এস এম শরিফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ঐ কমিশন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আইয়ুব সরকার এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ
এই তথাকথিত শিক্ষানীতিতে যে সকল বিষয় সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের মতো শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানদের স্বার্থে উচ্চ শিক্ষাকে সীমিত করা এবং সাধারণের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত করে ফেলা। শিক্ষা ব্যয়কে পুঁজিবিনিয়োগ হিসেবে দেখা, শিক্ষার্থীদের ওপর তা চাপিয়ে দেয়া, যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন; অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উল্লেখ; ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক; উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা; সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা; ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি।
এই সকল বিষয় ছাত্রসমাজ এবং সচেতন মহলকে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এরই পরিণতিতে শিক্ষার দাবিতে ছাত্র সমাজের আন্দোলন ব্যাপক রূপলাভ করে এবং ১৭ সেপ্টেম্বরের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন আইয়ুব সরকারকে বাধ্য করে ঐ শিক্ষানীতি স্থগিত করতে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠনের তৎপরতা বেআইনি করে সকল ধরনের মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়। চলে চরম দমননীতি। এরই মধ্যে ষাট সালের দিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা গোপন সমঝোতা ও যোগাযোগ রেখে নিজ নিজ সংগঠন গোছানোর এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন। এভাবে ছাত্র সংগঠন দু’টি ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে এবং সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলে।
তৎকালীন দুই বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসু ও বিভিন্ন হল ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। যার ফলে সকল আন্দোলন ও কর্মসূচির প্রতি সাধারণ ছাত্র সমাজের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
একদিকে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, অন্যদিকে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল এবং গণমুখী শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভে দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতে বিভিন্ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার দাবিতে ঐ হরতাল সারা দেশে অভূতপূর্ব সাফল্য এবং ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের সামরিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তখন সাধারণভাবে যে কোনো ধরনের আন্দোলন এমনকি ছাত্রসমাজের যে কোনো তৎপরতার ওপর সামরিক সরকার ছিল খড়গ হস্ত। ১৯৬২ সালের ১ ফেব্র“য়ারি থেকে সূচিত আন্দোলন দমন করার জন্য গ্রেফতার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি বেত্রদণ্ডসহ বর্বরোচিতভাবে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৭
সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও হরতাল কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য চরম নির্যাতনমূলক পথ গ্রহণ করা হয়। ঐ দিন ঢাকাসহ দেশের সকল শহরের রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ইত্যাদি তা দমন করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গণি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছনে থেকে অতর্কিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। সারা দেশে পুলিশ ও ইপিআর-এর নির্যাতন ও গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়।
১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ জনগণ ছাত্র সমাজের প্রতি আরও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের সমর্থিত ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুবের সামরিক সরকার তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এবং একটি গণমুখী সার্বজনীন আধুনিক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ও শহীদদের আত্মদান তথা শিক্ষার ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক ১৭ সেপ্টেম্বরকে সেদিন ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বহু উত্থান-পতনের মধ্যেও প্রতি বছর এই দিনটি ছাত্র সমাজ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছে। আজও শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবস’ অম্লান হয়ে আছে। সেই লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আজও সম্পূর্ণ সফল হয়নি।
পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি তাদের কায়েমি স্বার্থ এবং শাসন-শোষণ স্থায়ী করার লক্ষ্যে শিক্ষাকে ব্যবহার করার জন্য ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা চেয়েছিল শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখতে। তাই ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র জনতার ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে তথাকথিত ‘শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করলেও আইয়ুব খানের সরকার বা শাসক শ্রেণি তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
সরকার ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিশন গঠন করে। নতুন মোড়কে তাদের পরিকল্পিত শিক্ষা কমিশনের নাম দেওয়া হয়েছিল: Commission on Students’ Problem and Welfare বা ‘ছাত্রদের সমস্যা ও কল্যাণ কমিশন’। এই কমিশন দ্রুতই বছরের মাঝামাঝি তাদের রিপোর্ট প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করে। ‘হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ নামে পরিচিত এই রিপোর্ট বাস্তবায়নের জন্য বহু চেষ্টা ও কৌশল গ্রহণ করেও প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি।
এরপরও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী হাল ছাড়েনি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের ক্ষমতা ত্যাগ নিশ্চিত হলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় বসেই সীমিত সময়ে নির্বাচন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদানের ঘোষণা দিয়ে সর্বাগ্রে আবারও শিক্ষানীতি প্রণয়নে হাত দেয়। প্রায় চার মাসের মধ্যে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি কমিশন করে দ্রুত একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই পুরনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে -পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য নতুন প্রজন্মের ওপর তাদের চিন্তা-চেতনা চাপিয়ে দেওয়া। দেশের সমগ্র ছাত্র সমাজ এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে তা প্রত্যাখ্যান করে। কেবল সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সমর্থক পাকিস্তানি ভাবধারা ও শাসক শ্রেণির অনুসারী জামায়াতে ইসলামি ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্রসংঘ (বর্তমান ইসলামী ছাত্রশিবির) ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের শিক্ষানীতির পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে।
আমাদের গৌরবময় সকল সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিক গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর প্রায় অর্ধডজন শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীন দেশের একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এবারের শিক্ষা দিবস এক নতুন সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতে উদযাপিত হচ্ছে। বিগত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে জনগণের অভূতপূর্ব রায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার গঠনের ফলে ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবসের মূল লক্ষ্য এবং জাতির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের এক বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে আজ বাস্তবায়িত করেই ‘শিক্ষা দিবস’ এবং শিক্ষার জন্য আন্দোলনের সকল শহীদের স্বপ্ন সফল করে তোলা সম্ভব।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার এবং বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির স্বার্থে প্রণীত গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের ছাত্রসমাজ পরবর্তীকালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য যে ঐতিহাসিক ১১ দফার প্রথম দাবিই ছিল শিক্ষার দাবি।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকেই একজন কর্মী হিসেবে আমি নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত করেছিলাম। আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি গণমুখী শিক্ষানীতির জন্য ষাটের দশকে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেই আন্দোলনের প্রথম মিছিলে যোগদান এবং সিনিয়র নেতাদের সাথে থেকে সামগ্রিক আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক হিসেবে আমার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও আজ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে শিক্ষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সবসময়ই জড়িত রয়েছি। আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলন, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল সংগ্রাম এবং শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডের সাথে আজও যুক্ত আছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে গত প্রায় ১৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক এবং বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে শুধু সম্মানিতই করেননি, সেই সঙ্গে আমার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব অর্পণ করে এক কঠিন চ্যালেঞ্জিং কাজে নিয়োজিত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও পরিচালনায় এই দায়িত্ব পালন করার জন্য আমি জীবন বাজি রেখে নিজেকে নিয়োজিত করেছি। আমি আশা করি, সকলের সহযোগিতায় আমরা কাজ করে যাব, সকলে মিলে আমাদের সফল হতেই হবে। অন্য কেনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। পিছু হটার কোনো অবকাশ নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন তা আমাদের বাস্তবায়ন করতেই হবে। সেজন্য আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। আমাদের নতুন প্রজন্মকে যুগোপযোগী, মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে এবং সেই দক্ষ নতুন প্রজন্মকেই তা বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা, ঝরে পড়া বন্ধ করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রসারের মাধ্যমে আমাদের ব্যাপক তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করা, মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং উচ্চ শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করাসহ সামগ্রিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেকগুলো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্য বাস্তবে রূপায়িত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যে অনেকগুলো বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে শুরু করেছি। আশা করি, এগুলো দেশবাসীর অজানা নয়। তবে এগুলোর সুফল পেতে সময় লাগবে। শিক্ষকরা আমাদের আসল শক্তি। তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমরা সচেতন রয়েছি। আবার তাঁদের কাছেও জাতির দাবি নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তাঁরাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করে দিবেন। একদিকে তাদেরকে মানসম্মত আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে হবে; সেই সঙ্গে তাদেরকে নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে প্রকৃত শিক্ষিত, জ্ঞানী, সমাজ সচেতন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, আদর্শ ও চেতনা এবং ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন তথা শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ অর্থাৎ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, পশ্চাপদতার অবসান ঘটিয়ে আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে বাষট্টির ঐতিহাসিক শিক্ষানীতির আন্দোলনের ৫০ বছর পর জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে এখন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমাদের অতীতের শিক্ষার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এ বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
শুরু থেকেই আমি বলে এসেছি আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার অগ্রবাহিনী হিসেবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে চাই। তবে প্রচলিত শিক্ষা দিয়ে তা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক গুণগত পরিবর্তন করতে চাই। আমরা চাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক যুগের সাথে সংগতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে। সেই সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেই লক্ষ্যেই দেশের সকল মহলের মতামত গ্রহণ করে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, কোনো দলীয় নয়, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি যা সকল মহলই সমর্থন করেছেন। এখন চলছে এই জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের ব্যাপক কার্যক্রম। শিক্ষাক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে এবং তা প্রতিনিয়তই বেগবান হচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনের সার্থকতা ও আনন্দ সীমাহীন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির স্বার্থে প্রণীত প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জীবনের যে যাত্রা শুরু করেছিলাম প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেই পথ পরিক্রমায় আজ নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের এবং তা বাস্তবায়ন করে একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গণমুখী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রধান দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে। আমাদের জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারের বিষয়ে দায়িত্ব পালন করার চেয়ে একজন মানুষের জীবনে গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে?
শিক্ষা কোনো দলীয়, গোষ্ঠীগত, আঞ্চলিক বা সাম্প্রদায়িক বিষয় নয়। শিক্ষা সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের বিষয়। আমরা আশা করব, দেশের সকল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষ এবং দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণ তাদের সহযোগিতা দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়ন করার কাজে এগিয়ে আসবেন।
আসুন, বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে আমাদের শিক্ষার জন্য ঐতিহাসিক আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকীতে শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষাবিদ, তথা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল মহল এবং সকল শ্রেণির মানুষ তাদের মতামত ও পরামর্শ দিয়ে একটি গণমুখী শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে ১৯৬২ সালের শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি।
আমাদের শিক্ষার অধিকার এবং গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, যুগোপযোগী, প্রগতিশীল একটি শিক্ষানীতির জন্য অর্ধশতাধিক বছর ধরে যে সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চলমান তারই সফল পরিণতি হলো এবারের শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই হবে সাফল্যের আসল শক্তি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল তথা আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের আসল শক্তি আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তি, দক্ষতা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলাই আমাদের প্রধান কর্তব্য।
লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১২
আরআর