ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিক্ষা অধিকার সংসদের আত্মপ্রকাশ: একগুচ্ছ সুপারিশ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৪
শিক্ষা অধিকার সংসদের আত্মপ্রকাশ: একগুচ্ছ সুপারিশ

ঢাকা: বৈষম্যহীন, যুগোপযোগী ও গতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণে শিক্ষা অধিকার সংসদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে এ ফোরামের ঘোষণা দেওয়া হয়।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরিয়াল ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা-গবেষক অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহকে আহ্বায়ক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দনকে এ সংসদের সদস্য সচিব করা হয়েছে।

সংগঠনটির নির্বাহী সদস্যদের অন্যতম- মিসবাহুর রহমান আসিম, মাহফুজুর রহমান মানিক, ওমর ফারুক, রমিজুল ইসলাম রুমি ও মিনহাজুল আরেফিন।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা অধিকার সংসদ শিক্ষা সংস্কারে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-

১. স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন: শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ, গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের নেতৃত্বে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশন নিশ্চিত করবে শিক্ষা বিষয়ক যেকোনো সংস্কার কার্যক্রম বা শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন পদক্ষেপ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গবেষণা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে গ্রহণ করতে হবে।

২. শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন আধুনিকায়ন: সব স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে জুলাই বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নবগঠিত শিক্ষা কমিশন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ পুনর্মূল্যায়ন করবে এবং বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষানীতি ও তার আলোকে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করবে। শিক্ষা দক্ষতাভিত্তিক হতে হবে। মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষায় সমমান নিশ্চিত করতে হবে যেন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সহজেই কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের সমাপনী পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কার করে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে; যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণী দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, সৃজনশীলতা, যোগাযোগ দক্ষতা, মানসিক দক্ষতা, মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির যথাযথ মূল্যায়ন করা যায়।

৩. শিক্ষা মান যাচাই ব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণ: দেশের শিক্ষা প্রশাসনের কাজের মান যাচাই ও মূল্যায়নে একটি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ফর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশ, যার সূচনা হতে পারে এর পাইলট সংস্করণ।

৪. এডুকেশন পারফরম্যান্স ডেলিভারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা: এই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষা ও কর্মক্ষমতা ডেলিভারি ইউনিট শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত পরিকল্পনার জন্য ডেটা চালিত এবং প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতি নিশ্চিত করবে।

৫. পাঠদানের ব্যাঘাত প্রতিরোধে শিক্ষা রক্ষাকবচ চালু: সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থাকে শেখার ব্যাঘাতে মোকাবিলায় স্থিতিস্থাপক করুন। অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হওয়া স্কুল বন্ধ হওয়ার পরও যাতে শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া দুর্যোগ বা যেকোনো কারণে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটলে যাতে দ্রুত ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায় শিক্ষাব্যবস্থায় সে নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। একইভাবে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের শিখন পুষিয়ে নেওয়ার নির্দিষ্ট লার্নিং রিকভারি কর্মসূচি থাকা চাই।

৬. নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাঙ্গনের নিশ্চয়তা: সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সকল প্রকার নিপীড়নমুক্ত করে সবার জন্য নিরাপদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০০৯ সালে গৃহীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশিকাটি মাথায় রেখে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষায় একটি নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

৭. শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি: জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধারার মধ্যে সর্বোচ্চ সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এটি সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তি এবং সব থেকে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী এখানে অন্তর্ভুক্ত থাকে। শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, সব ধরনের শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তি ও প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

৮. শিক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা: মাধ্যমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা উপবৃত্তি বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম, অদক্ষতা ও বৈষম্যের নজির রয়েছে। এজন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মনিটরিং কমিটি গঠন করে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা দূর করা; পথশিশুদের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ বা উপবৃত্তি বা আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পথশিশুদের অন্তর্ভুক্তি ও তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকে বিরাজনীতিকরণ: সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রগুলোকে (যেমন– উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সিনেট, সিন্ডিকেট, ট্রাস্টি বোর্ড বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপনা কমিটি) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

১০. শিক্ষকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি: শিক্ষাক্রমের অপরিকল্পিত পরিবর্তনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তা নিরসনের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উপকরণ সরবরাহ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমে উপকরণের ব্যবহার ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণলব্ধ দক্ষতার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে একটি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

১১. বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ন্ত্রিত প্রসার সংকোচন ও মানের পুনর্মূল্যায়ন: বিপুল সংখ্যক নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাওয়া এবং উচ্চশিক্ষার ব্যাপক চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে উচ্চশিক্ষা সংস্কারে একটি পৃথক কমিশন গঠন করতে হবে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও মানসম্মত গবেষণা নিশ্চিত করতে ইউজিসির ক্ষমতায়ন, নেতৃত্বের অরাজনৈতিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ও ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) সক্রিয় করতে হবে এবং বাংলাদেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে।

১২. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মৌলিক সংস্কার সাধন: শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, উন্মুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক ও আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষা গবেষকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে।

১৩. শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব, ক্ষমতায়ন ও কার্যকর ছাত্র-সংসদ: উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তে ছাত্র-সংসদ ভিত্তিক ছাত্র-রাজনীতির প্রচলন করতে হবে। নিয়মিতভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আবাসন সংকট নিরসন, খাদ্যমান বৃদ্ধি, শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন ও নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে শিক্ষার্থী-শিক্ষক যৌথ একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।

১৪. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অন্যান্য দেশের তুলনায় নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৪
এমআইএইচ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।