সিলেট: উগ্র সাম্প্রদায়িকতার হুমকির মুখে পড়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপন।
ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ হলেও তা স্থাপন নিয়ে রয়ে গেছে অনিশ্চয়তা।
ধর্মঘট ও হরতালের ডাক দেওয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছে কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠন।
তবে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে শাবিপ্রবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস সোমবার সকালে ভাস্কর্য নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেন। সংঘাতের আশঙ্কায় সিসিটিভি দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে প্রশাসন।
অপরদিকে, সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, শাবিপ্রবির প্রবেশ গেট থেকে এক কিলোমিটার দূরে গোলচত্বরের অবস্থান। গোলচত্বরের ঠিক মাঝখানেই মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য স্তম্ভ নির্মাণের কাজ কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক।
তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, আর ২/১ দিনের মধ্যে স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হবে। এর পর স্থাপন করা হবে ভাস্কর্য। গোলচত্বরের পাশেই লাইব্রেরি ভবন। ভবন থেকে সিসিটিভি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে পরিস্থিতি।
এ ব্যাপারে শাবিপ্রবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য রয়েছে। সুতরাং শাবিপ্রবিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিগগিরই ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে। ’’
তিনি বলেন, ‘‘ভাস্কর্যের ডিজাইন এবং নকশার চূড়ান্ত কাজও শেষ। এ মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। ’’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে শাবিপ্রবি’র ভারপ্রাপ্ত ভিসি বলেন, ‘‘প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ’’
এদিকে, বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা এক বিবৃতিতে জানান, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার রোলকে পাশ কাটিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের পরিবর্তে খুব শিগগিরই স্থাপন হতে যাচ্ছে ভাস্কর্যের নামে মধ্যযুগীয় ধাঁচের মূর্তি।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবি ছিল শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা সৌধ হবে। শাবিপ্রবির মাস্টার রোল অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের সম্মানার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে তৎকালীন স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির কথা বিবেচনা করে ১৪৯তম সিন্ডিকেট সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন শাবিপ্রবির ৭০ জন শিক্ষক। এর মধ্যে আওয়ামীপন্থি কয়েকজন শিক্ষকের স্বাক্ষরও দেখা গেছে।
ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটি সূত্রে জানা যায়, ৪৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন দেশের সর্বোচ্চ ভাস্কর্য হবে এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে স্থাপন করতে ইতোমধ্যে ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সদস্য ড. ইউনুস, ড. রাশেদ তালুকদার, সুশান্ত কুমার দাস, সৈয়দ হাসানুজ্জামান শ্যামল ও মস্তাবুর রহমান।
অন্যদিকে, ভাস্কার্য নির্মাণের প্রতিবাদে সিলেটে নগরীতে বেশ কয়েকটি ইসলামীপন্থি সংগঠন সভা-সমাবেশ ও মিছিল করছে বেশ কয়েকদিন ধরে।
এসবের পেছনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
শাবিপ্রবি’র এক শিক্ষার্থী আমিনুল করিম মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘সিলেটে মাজার জিয়ারতসহ এমন অনেক কিছুই আছে, যা মৌলবাদী মনোভাবাপন্নদের সঙ্গে যায়না। গোল চত্বরে নির্মাণাধীন যে ভাস্কর্য নিয়ে একটা গোষ্ঠীর এত চক্রান্ত, তার পেছনে একটাই কারণ থাকতে পারে, তাহলো ভাস্কর্যটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের থিম নিয়ে ডিজাইন করা। `৭১-এ পরাজিতদের অনুসারীরাই এ বিরোধিতার পিছনে দায়ী বলে মনে করি। ’’
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন মৃত্তিকা-র সভাপতি খলিলুর রহমান ফয়সাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য থাকা উচিৎ। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশেও সে দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে এ রকম ভাস্কর্য রয়েছে। কিছু অসচেতন ও ‘অশিক্ষিত’ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য এর বিরোধিতা করছে।
তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এ রকম ভাস্কর্য শাবিপ্রবির পাশাপাশি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থাপন করা দরকার। ’’
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৩
এসএ/আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর