ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া সেন্টার থেকে: এখনও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান অর্জন সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
দেশের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান আয়োজিত ‘পাশের হার বৃদ্ধি: শিক্ষার মানের হ্রাস-বৃদ্ধি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করতে গিয়ে একথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
রাজধানীর বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া সেন্টারে শনিবার আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ডেইলি সান সম্পাদক আমীর হোসাইন।
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথির বক্তব্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, এখনও আমরা শিক্ষার প্রত্যাশিত মান অর্জন করতে পারিনি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফল প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রতি বছরই ফল ভাল হচ্ছে। অথচ কিছু লোক শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করছেন। দুনিয়ার সকল দেশে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতা আছে। উচ্চ শিক্ষার প্রতিযোগিতা বিশ্বের সকল দেশেই আছে। উচ্চ শিক্ষায় যদি আমরা সকলেই যাই তাহলে কি কাজ হবে? হাজারে হাজারে পাশ করে বেরুচ্ছে তারা কাজ পাবে কোথায়?
‘বাস্তব জীবনের সাথে শিক্ষাকে মেলাতে না পারলে কোনো শিক্ষাই কাজে লাগবে না’ বলে উল্লেখ করেন শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমাদের যে মান অর্জন করা উচিৎ সে মান আমরা অর্জন করতে পারছি না। বর্তমান দুনিয়ার সাথে মানানসই করে তুলতে হলে আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কেবল বড় ডিগ্রি দিয়ে হবে না। মান কমছে না, মান বাড়ছে। কিন্তু আমরা যে মান অর্জন করতে চাই সে মান থেকে আমরা অনেক দূরে আছি।
শিক্ষামন্ত্রী এ সময় শিক্ষাখাতে তার সরকারের নানা অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে বলেন, সাধারণভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। ছোটো থাকতেই তারা মোবাইল কম্পিউটার ব্যবহার করছে। বেশিরভাগ স্কুলে এখন কম্পিউটার আছে। ১০ লাখ মাধ্যমিক শিক্ষককে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি সৃজনশীল শিক্ষা দিতে। পাশ করলে এখন আমরা আটকাবো কেমন করে। ২০ হাজার ৫০০ স্কুলে আমরা ডিজিটাল ক্লাসরুম কনটেন্ট চালু করেছি। আরো ৩০০০ স্কুল প্রক্রিয়াধীন আছে। আমাদের কারিকুলাম ১৭ বছর আগের। তখন মোবাইল ছিল না। সেগুলো আপডেট করেছি। ১১১টি নতুন বই আমরা চালু করেছি।
তিনি বলেন, ১৭টা মোবাইল ল্যাবরেটরি চালু করেছি। রাজধানীতে ১০০ টি স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব চালু করেছি। পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য কমিশন করতে যাচ্ছি। কাজ প্রায় শেষ। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে শিক্ষকদের, প্রিন্সিপালদের।
‘মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতায় আসছেন না’ উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কোনো পেশা না পেয়ে সর্বশেষ এসে শিক্ষক হচ্ছেন।
তিনি বলেন, সাড়ে আট হাজার স্কুলে অংক এবং ইংরেজিতে একজনও শিক্ষার্থী পাশ করেনি। সেই স্কুলগুলোতে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ ক্লাস করিয়ে নিতে হয়েছে। ফলে ওই স্কুলগুলোর ছেলেমেয়েরা পাশ করেছে।
এ সময় স্কুলগামী শিশুদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, শতকরা ৯ জন শিশু স্কুলেই যায় না। ৪৫ শতাংশ ঝড়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণি থেকে। আমরা ৯৯ শতাংশ শিশুকে স্কুলে নিয়ে এসেছি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের ধরে রাখা।
শৈশবে একটি শিশু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললে সে কখনো সাহসী হয়ে উঠতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
গত বছর সরকার ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬ টি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সমতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা একসাথে পরীক্ষা নিচ্ছি। বাচ্চারা পরীক্ষাটিকে উৎসবের মতো করে নিয়েছে। আত্মবিশ্বাস না বদলালে আমরা দেশ বদলাতে পারবো না। অষ্টম শ্রেণি থেকে কারিগরি বিষয় যুক্ত করে দেবো।
এছাড়া ভর্তি বাণিজ্যে প্রতি বছর ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলেও এ সময় উল্লেখ করেন শিক্ষামন্ত্রী।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক প্রফেসর ড. ওয়াহিদুজ্জামান, নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. শামসুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আব্দুল মান্নান, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক হায়াত মামুদ।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে দেশের মানুষ চমকে উঠেছে।
তিনি বলেন, পাশের হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু মান কতটুকু বেড়েছে সেটাই এই আলোচনার বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র ভর্তি পরীক্ষা দেখে চমকে উঠেছে মানুষ। ইংরেজি বিভাগে দুজন মাত্র চান্স পেয়েছে।
নঈম নিজাম বলেন, নিয়োগ দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিয়োগপ্রার্থীরা ইংরেজি থেকে বাংলায় ভালেঅ অনুবাদ করতে পারছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসার পরও তারা ভাল ইংরেজি পারছে না। আমি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট।
মাদ্রাসা শিক্ষা এখনো মূল ধারার শিক্ষার সাথে এক হতে পারছে না। মাদ্রাসায় এখনো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে না। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। মূল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তন যদি না আনা হয় ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে।
ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমের জন্য এখনো নীতিমালা হয়নি। প্রচুর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে সেটা ইতিবাচক। কিন্তু মান রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রফেসর ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শিক্ষায় পাশের হার বাড়া অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে কি না সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। পাশের হার বাড়বে কারণ, সমাজের সর্বস্তর থেকেই শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে পাশের হার বাড়ছে। কারণ পরীক্ষার ট্রাডিশনাল পদ্ধতি ভেঙে এখন ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করছে।
সময়ের সাথে শিক্ষার মানের বিষয়টিও পরিবর্তন হয়েছে। সেভাবেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু আমাদের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। প্রশ্নের ‘পারসেপশান’ ঠিক হয়নি। প্রশ্নের মান ভাল হয়নি।
শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে উপযুক্ত শিক্ষক দরকার। আমরা কি সে জায়গাটি নিশ্চিত করতে পারছি? এই জেনারেশনকে হীনমন্য করা হয়েছে যে, ‘তোমরা কিছু পার না। তরুণ প্রজন্মের মেধা মনন আমাদের চেয়ে ভাল। এই মেধা মনন কিভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা আমাদের ভাবতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ‘টিচার ইজ দ্যা বেস্ট কারিকুলাম’। শিক্ষকতা করার জন্য কেউ শিক্ষক হচ্ছে না, চাকরি করার জন্য শিক্ষক হচ্ছেন অধিকাংশ শিক্ষক। ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় বিপর্যয়ের দায় আমাদের। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী যেন হতাশ না হন। মনে রাখতে হবে তারা ভর্তি হওয়ার যোগ্য আমরা তাদের ফেল করিয়েছি। ’
হায়াত মামুদ বলেন, আমাদের স্কুলের লেখাপড়ার মান খুবই খারাপ। এমএ পাশ করলেই শিক্ষক হওয়া যায়। মাস্টারি আসলে ডাক্তারি পেশার মতোই। কিভাবে পড়ালে পড়াশোনাটা কাজে লাগবে সেটা নির্ভর করে মাস্টারের উপর। ভাষা শেখাটাও অভ্যাসগত ব্যাপার। স্কুলে যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করা না হয়, শেখানো না হয় তাহলে শিখবে কোথায়? ভাষার বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে, শিক্ষকদেরও। ভাষা নিরন্তর চর্চার বিষয়। আর যারা ভাষাটা শেখাবেন তাদেরও একটু বাছাই করে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজের করে নিতে হবে।
ড. শামসুল হক বলেন, গ্রেডিং পদ্ধতি ব্রিটিশ পদ্ধতি। গ্রেডিং পদ্ধতিতে সাবজেক্টিভিটি নেই। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়াতে পারে তার জন্য একটি বিশ্লেষণ হতে পারে।
পঞ্চম শ্রেণি থেকে এখন পাশ করার প্রতিযোগিতা। ভাল করার প্রতিযোগিতা। এতে শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণিতেই পাবলিক পরীক্ষা হলেই মান বাড়বে সেটা ঠিক না। বরং বিষয়টি শিক্ষার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পরীক্ষা ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। সেটা বোর্ডভিত্তিক হতে পারে। প্রশ্ন আলাদাও হতে পারে।
** ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে চমকে উঠেছে মানুষ
** বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিফটে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে
বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪/ আপডেটেড-১৩৪১ ঘণ্টা/১৪১৬ ঘণ্টা