ঢাকা: জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এর আয়োজন করা হয়েছিল ‘পাসের হার বৃদ্ধি: শিক্ষার মানের হ্রাস-বৃদ্ধি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের।
শনিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট-ওয়েন্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স রুমে ডেইলি সান-এর সম্পাদক আমীর হোসাইনের সভাপতিত্বে এ গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।
এতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের বাংলা দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ এবং দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’র সম্পাদক, ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তায়েব, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচ্য বিষয়ে আলোচকদের আলোচনার সারাংশ পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো:
ভর্তি পরীক্ষা দেখে চমকে উঠেছে মানুষ!
দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, পাসের হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু মান কতটুকু বেড়েছে, সেটাই এই আলোচনার বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র ভর্তি পরীক্ষা দেখে চমকে উঠেছে মানুষ।
তিনি বলেন, ইংরেজি বিভাগে দুজন মাত্র চান্স পেয়েছে! আসলে, এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে।
মাদ্রসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার
জনপ্রিয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা এখনো মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে এক হতে পারছে না। মাদ্রাসায় এখনো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে না। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। মূল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তন যদি না আনা হয়, ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে।
তিনি বলেন, ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমে এখনো নীতিমালা হয়নি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে, সেটা ইতিবাচক। কিন্তু মান রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের দায় আমাদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষক প্রফেসর ড. ওয়াহিদুজ্জামান চান বলেন, শিক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, পাসের হার বাড়বে; কারণ, সমাজের সর্বস্তর থেকেই শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে ছেলেমেয়েরা। তাছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে পাসের হার বাড়ছে। কারণ, পরীক্ষার ট্রাডিশনাল পদ্ধতি ভেঙে এখন ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। প্রশ্নের পারসেপশন ঠিক হয়নি। প্রশ্নের মান ভালো হয়নি। এই জেনারেশনকে হীনমন্য করা হয়েছে যে, তোমরা কিছু পারো না। তরুণ প্রজন্মের মেধা-মনন আমাদের চেয়ে ভালো। এই মেধা-মনন কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি, সেটা নিয়েই ভাবতে হবে।
ড. ওয়াহিদুজ্জামান চান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বিপর্যয়ের দায় আমাদের। মনে রাখতে হবে, তারা ভর্তি হওয়ার যোগ্য। আমরা তাদের ফেল করিয়েছি।
শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে উপযুক্ত শিক্ষক দরকার। আমরা কি সে জায়গাটি নিশ্চিত করতে পারছি? শিক্ষকতা করার জন্য কেউ শিক্ষক হচ্ছেন না। চাকরি করার জন্য শিক্ষক হচ্ছেন অধিকাংশ শিক্ষক।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হায়াৎ মাহমুদ বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পরীক্ষা ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। সেটা বোর্ডভিত্তিক হতে পারে।
তবে ভর্তুকি বাড়িয়ে শিক্ষা গবেষণা খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
হায়াৎ মামুদ বলেন, স্কুলের লেখাপড়ার মান খুবই খারাপ। এমএ পাস করলেই শিক্ষক হওয়া যায়। শিক্ষকতা পেশাটা আসলে ডাক্তারি পেশার মতোই। কীভাবে পড়ালে, কতটুকু পড়ালে, পড়াশুনাটা কাজে লাগবে সেটা নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। কিন্তু, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রমিত ভাষায় কথা বলতে পারেন না। ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটি নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে
উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কারণে শৈশবেই শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শামসুল হক।
তিনি বলেন, পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি হচ্ছে ব্রিটিশ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি কতটুকু সৃজনশীল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এতে একজন শিক্ষার্থীর পটেনশিয়ালিটি (সম্ভাবনা) বোঝার উপায় নেই। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়াতে পারে, তার জন্য একটা বিশ্লেষণ হতে পারে।
তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণী থেকে এখন পাস করার প্রতিযোগিতা। ভালো করার প্রতিযোগিতা। এতে শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। এতে শিক্ষার মান বাড়ছে না বরং শিক্ষার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে।
যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের অভাব
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, শিক্ষার প্রত্যাশিত মান আমরা পাচ্ছি না। দেশে শিক্ষার চাহিদা বাড়লেও যোগান বাড়েনি। যোগান আগের তুলনায় বাড়লেও যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েই যাচ্ছে। শিক্ষার মান অনেকাংশেই নির্ভর করে ভালো শিক্ষকের ওপর।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে হবে
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী মনে করেন, গ্রাম এবং শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রামের শিক্ষার্থীরা আয় ও সুবিধা বৈষম্যের শিকার।
তিনি গ্রাম এবং মফস্বলের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রণোদনারও দাবি করেন।
তিনি বলেন, এই পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা তুলে দিয়ে ‘উইলিং অ্যান্ড অ্যাবল’ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত এবং একই দিনে একই সময়ে সবগুলো বিশ্ববিদ্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত। এতে অভিভাবকদের হয়রানি কমবে।
** ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে
** শিক্ষার প্রত্যাশিত মান অর্জন করতে পারিনি
** ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে চমকে উঠেছে মানুষ
** বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিফটে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪