ঢাকা: জ্ঞানী-গুণীজনেরা যা বলেন তাই লিখে পাঠকের সামনে তুলে ধরি। সাংবাদিকতা পেশায় এসেছি বছর পাঁচেক।
স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি সময়ের সব থেকে আলোচিত বিষয় (আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বিষয় বাদ দিয়ে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের যেমন আছে পাল্টা পাল্টি বক্তব্য তেমনি চায়ের দোকান থেকে অফিস আদালতের আড্ডাতেও বিষয়টি নিয়ে চলছে সরল গরল নানা আলোচনা সমালোচনা।
কলাম লিখছেন দেশের রথী মহারথীরা। আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রিয় শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারও লিখেছেন কলাম। স্যারকে আমার মতো অনেকে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা অধ্যাপক মনে করেন ও মানেন। এমন একজন স্যারের কথায় দ্বিমত করার অথবা যুক্তির পাল্টা যুক্তি দেওয়ার কোনো সাহস অথবা জ্ঞান কোনোটিই আমার নেই। তারপরও নিজ চোখে যা দেখেছি, নিজ কানে যা শুনেছি তার ভিত্তিতেই কিছু বলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ইংরেজি অংশের একটি প্রশ্ন ছিল কোনটি সঠিক উত্তর। প্রশ্নটির অপশনগুলো ছিল A. Where have you born? B. Where are you born? C. Where were you born? D. Where had you born? । বিজ্ঞান বিভাগ থেকে (এসএসসি ও এইচএসসি) পাস করে আশা একটি ছেলের উত্তর দেওয়া অপশনটি ছিলো D। অর্থাৎ তার মতে সঠিক উত্তর Where had you born?
আমি ছেলেটিকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনি দিনে কত ঘণ্টা ইংরেজি পড়েন। উত্তরে সে বলে বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো পড়তে পড়তেই সময় চলে যায় প্রতিদিন ইংরেজি পড়ার সময় কোথায়। আরও আবাক হলাম তার পরের উত্তরটি শুনে। ছেলেটি জানায় এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষাতে সে জিপিএ ৫ পেয়েছে।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া একটি ছাত্র যখন ‘Where had you born?’ কে সঠিক বাক্য বলে তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে আমাদের শিক্ষার মান আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?
আসছি শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কথায়। বৃহস্পতিবার স্যারের লেখা ‘আমাদের ছেলে-মেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এবং অপমান’ শিরোনামে একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। বরাবরের মতো স্যার অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় শিক্ষার্থীদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এবং অপমানের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
একটি স্থানে স্যার লিখেছেন ‘আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগে পড়ার মতো যোগ্যতা রাখে। আমি যদি তাদের খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে তার দায়-দায়িত্ব ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, শিক্ষাব্যবস্থারও নয়; তার দায়দায়িত্ব যারা খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের। ’
সম্পূর্ণ নিবন্ধের কোথাও দ্বিতম পোষনের ধৃষ্টতা আমি দেখাতে চাই না। এমনকি উদ্ধৃত অংশটিরও না। তবে ‘দায়-দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থারও নয়’ এই শব্দের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারছি না। হয়তো আমার মতো অনেকেই একমত হবেন না। আসলেই কি আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক পথে আছে?
আমার স্বল্প জ্ঞানে যা বুঝি মনকে জাগ্রহ করতে, আত্মার অপমৃত্যু ঠেকাতে, সুশিক্ষা গ্রহণ করতে প্র্রয়োজন সাহিত্য চর্চার। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে সাতিত্য চর্চার কোনো সুযোগ আছে কি? সাহিত্য চর্চার জন্য প্রয়োজন লাইব্রেরি। আমাদের এ সম্পদ আছে কি? স্কুল-কলেজগুলোতে তন্ন তন্ন করে খুজলে হয়তো দুই এক জায়গায় মিললেও মিলতে পারে এ সম্পদ (লাইব্রেরি)।
আমার জন্মস্থানের (সংসদীয় আসন ঝিনাইদাহ-৩) কথাই ধরি। এখানে দুটি সরকারি কলেজসহ আছে ডজনের উপর কলেজ। আর হাই স্কুল ও প্রাইমারি স্কুল এক মহল্লাতেই আছে হালির উপরে। কিন্তু লাইব্রেরি! সম্পূর্ণ সংসদীয় আসনে দুই একটি থাকলেও তার নাম অথবা সেখানে কি ধরনের বই পড়া যায় এলাকার ৯৯ শতাংশ মানুষই তা জানেন না। আর দুই একটি কলেজে লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে সিলেবাসের বাইরের কোনো বই নেয়।
এবার আসছি রাজধানীর কথায়। প্রতিটি এলাকার মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্কুল-কলেজ। মসজিদের নগরি ঢাকাকে এখন স্কুল-কলেজের নগরি বললেও হয়তো ভুল হবে না। এসব স্কুল-কলেজগুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে অধিকাংশই গড়ে উঠেছে আবাসিক অথবা বাণিজ্যিক স্থান ভাড়া নিয়ে। শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থের বিনিময়ে যেখান থেকে ধরিয়ে দেওয়া হয় সনদ।
আর সনদ পেয়ে শিক্ষার্থী যেমন খুশি তেমনি খুশি অভিভাবকও। খুশি তো হতেই হবে কারণ আমাদের লক্ষ্য যে শিক্ষা অর্জন নয়, অর্থ উপার্জন!
আবার আসছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া একটি ছাত্র যখন ‘Where had you born?’ কে সঠিক বাক্য বলে তখনো কি জাফর ইকবল স্যার বলবেন আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি সঠিক পথে আছে? এর দায়-দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার নয়। আমি মানি একটি ছাত্রকে দিয়ে সবাইকে বিবেচনা করা ঠিক না। এমনটি চিন্তা করাও অন্যায়। তারপরও মনে রাখতে হবে ওই শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ রেজাল্ট (এসএসসি ও এইচএসসি) করাদের একজন।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন আমি দেখেছি। তাতে আমার মনে হয়েছে আমার মতো যারা ইংরেজি উচ্চারণ করতে গিয়ে বার বার অ্যা অ্যা (খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করা) করেন তাদের পক্ষেও ওই প্রশ্নপত্রে পাস করা খুব একটা কঠিন ছিলো না।
বাস্তবে দেখা গেলো ওই প্রশ্নপত্রে পাস করেছেন মাত্র ১৬ শতাংশের মতো অংশগ্রহণকারী। অর্থাৎ ১০০ জনের ৮৪ জনই পাস করতে পারেননি। অথচ ফেল করা এই শিক্ষার্থীদের কেউ এসএসসি ও এইচএসসি কোনো পরীক্ষাতেই জিপিএ ৪’র কম পাওয়া না।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকে রানাপ্লাজা ধসের তারিখ, পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার তারিখের ক্ষেত্রেও সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। উত্তর দিতে পারেননি আলোকিত মানুষ গড়ার দায়িত্ব কোন সংগঠনের (অপশনগুলো- ১. গ্রামীণ ব্যাংক ২. আশা ৩. ব্রাক ৪. বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র)।
পারবেন কি করে? আমরা যে আমাদের শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছি সিলেবাসভূক্ত পাঠ্য বইয়ের ভিতরে। লক্ষ্য যে আমাদের জিপিএ। সেখানে আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা জানা বা মনে রাখার সময় কোথায়!
এটা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা না? শুধুই অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য নিয়ে সিলেবাসভূক্ত পাঠ্য বই গিলিয়ে আমরা যে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রোবট বানাচ্ছি এর দায় দায়িত্ব কি শিক্ষাব্যবস্থার না?
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, আক্টোবর ০৬, ২০১৪