সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। আমরা জানি এরই মধ্যে ঢা.বি. দ্বিতীয়বার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম আগামীবার থেকে নিষিদ্ধ করেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ার ইচ্ছা নিয়ে প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রস্তুতি নেয়। দুঃখের বিষয়, এই তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আগে ২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একবারও জানতে পারল না যে এটাই তাদের শেষ সুযোগ। এই শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন আজ বিপন্ন। ঢা.বি’র এই ঘোষণার কিছুদিন পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও একই ঘোষণা দিয়েছে যে তারাও আগামীবার থেকে দ্বিতীয়বারের শিক্ষার্থীদের কোনো সুযোগ দেবে না। এটাকে নজির হিসেবে নিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও (যাদের অনেকেই এই বছরের ভর্তি ফরম এরই মধ্যে নেওয়া শেষ করেছে)এই পদ্ধতি আগামী বছর থেকে শুরু করতে পারে। ফলে ২০১৪ ব্যাচ, আগে থেকে যারা জানত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দ্বিতীয়বার আবেদনের সুযোগ তারা পাবে, তাদের ভাগ্যও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। প্রায় আট লক্ষ পরিক্ষার্থীর এই ব্যাচের জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হঠাৎ-নেওয়া-সিদ্ধান্তে আজ ভেঙে চুরমার।
ঢা.বি.সহ বাংলাদেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যাদের সুনাম অনেক বেশি, তাদের ভর্তি পরীক্ষা যে কত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তা আমরা জানি। একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৪০ জনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় একটি আসনে। একটি অতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষার আগে একজন শিক্ষার্থীর কি এতটুকু জানার অধিকার নেই যে এটাই তার শেষ সুযোগ?
অনেকেই বলছেন, এই সিদ্ধান্ত দুইবছর আগে বা অন্তত এক বছর আগে শিক্ষার্থীদের জানানো উচিত ছিল যাতে একটি ব্যাচের (২০১৪) অন্তত মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থীরা আগে থেকে সাবধান হতে পারত। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কি অন্তত-- ২০১৬ সাল থেকে কার্যকর করা উচিত না?
ব্যক্তিগতভাবে এক শিক্ষার্থীকে আমি চিনি যে এবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমার হলে বেশ কিছুদিন ধরে অবস্থান করছে। তার ভাষ্য, সে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম নেয়নি এই ভেবে যে সে জানত ঢা.বি. তে আর একবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ তার রয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর, ২০১৩ একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানো সুবিধাবঞ্চিত এক শিক্ষার্থী (২০১৪ ব্যাচ) আব্দুল্লাহ আল মামুন-এর ভাষ্য, এবার ঢাবিতে পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফল দেখে সে বুঝতে পারে তার পক্ষে ঢাবিতে চান্স পাওয়া সম্ভব এবং সে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম না নিয়ে সোজা বাড়ি গিয়ে পড়তে বসে যায় আগামীবার ঢা.বি. ভর্তি পরীক্ষার জন্য।
মামুনের মত অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা এবার ঢা.বিতে প্রথমবারেই অপেক্ষমান তালিকায় ছিলেন এবং আগামীবারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলির (ঢা.বি. ও জ.বি.) এই সিদ্ধান্তের পর হতভাগ্য শিক্ষার্থীরা কি বলে নিজেদের সান্ত্বনা দেবে? যেহেতু আগে থেকে জানানো হয়নি, তাই অন্তত ২০১৪ ব্যাচকে আরেকটি সুযোগ দেওয়া কি উচিত নয়?
ঢাবি’র সম্মানিত ভিসি মহোদয়ের মতে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলির কারণে দ্বিতীয়বার ভর্তি সুযোগ বাতিল করা হয়েছেঃ
সমস্যা ১: দ্বিতীয়বার ভর্তি সুযোগের কারণে বিভাগ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আসন ফাঁকা থাকে।
সমস্যা ২: প্রথম বছরের পরীক্ষার্থী ও দ্বিতীয় বছরের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা।
সমস্যা ৩: দ্বিতীয়বারের শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সুযোগ নেয়, যা করা হয় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে। (ব্যাখ্যাঃ পরীক্ষার্থী ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে তার প্রশ্নপত্রের সেটকোড জানিয়ে দেয় বাইরের কিছু অসাধু মানুষের কাছে, যারা এই সেটকোডের সকল উত্তর পরীক্ষার্থীর কাছে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে পৌঁছে দেয়। )
সমস্যা ৪: শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতা কমানো। অনেকেই এসব সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন গঠনমূলক সমাধানের কথা বলেছেন। একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি বলতে চাই যে কোনো সামাজিক সমস্যার অনেকগুলি সমাধান দেওয়া যায় এবং এই সমাধানগুলির মধ্যে ঐটিকেই বেছে নিতে হবে যেটির কারণে সামগ্রিকভাবে সামাজিক ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
উপরের সমস্যাগুলির কয়েকটির সমাধান এমন হতে পারেঃ
সমস্যা ১, সমাধানঃ আসন সংখ্যা যাতে ফাঁকা না থাকে তাই এমন করা যেতে পারে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী যদি প্রথমবার কোনো বিষয়ে ভর্তি হয় তাহলে দ্বিতীয়বার তাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রথমবার ভর্তি না হয় বা মেধা অনুযায়ী ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পায়, তবেই সে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। এর ফলে অকারণে একটি বিষয়ে ভর্তি হয়ে পরের বছর আবার ভর্তিপরীক্ষা দেওয়ার অভ্যাস দূর হবে।
সমস্যা ২, সমাধানঃ অসম প্রতিযোগিতা দূর করার জন্য দ্বিতীয়বারের শিক্ষার্থীদের নম্বর থেকে কিছু অংশ কর্তন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মেডিকেল কলেজে ১ম বার ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয়বার ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নিলে ৫% নম্বর কর্তন করা হয়। আরেকটি সমাধান হতে পারে সর্বমোট আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট অনুপাতে ১ম ও ২য় বারের শিক্ষার্থীদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে।
যেমন, ১ম বারে শিক্ষার্থীরা ৬০% আসন পাবে এবং ২য় বারের শিক্ষার্থীরা ৪০% আসন পাবে। এইচএসসি উত্তীর্ণ সকল ব্যাচ ১ম ও ২য় বছর যথাক্রমে এই সুবিধা পাবে যাতে কোনো ব্যাচের প্রতি অবিচার করা না হয়।
সমস্যা ৩, সমাধানঃ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাহায্যে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে পরীক্ষার নকল ঠেকাতে প্রথমেই যা করতে হবে তা হচ্ছে প্রশ্নপত্রে সেটকোড উলেখ না রাখা। কারণ এই সেটকোডটিই একজন পরীক্ষার্থী মুঠোফোনের মাধ্যমে বাহিরের কিছু অসৎ লোকের কাছে পাঠিয়ে দেয়, যারা তাদের কাছে থাকা প্রশ্নপত্রের সাথে সেটকোড মিলিয়ে তার সঠিক উত্তরগুলি পরীক্ষার্থীকে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেন।
এক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রে সেটকোডের পরিবর্তে এমন একটি সিরিয়াল নাম্বার প্রণয়ন করা যেতে পারে যার মাধ্যমে সেট কোডের তথ্য গোপনে রক্ষিত থাকবে (OMR readable), কিন্তু সিরিয়াল নাম্বারটি দেখে কোনোভাবেই সেট কোড নির্ণয় করা যাবে না। এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের সিরিয়াল নাম্বার হবে আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, সেটকোডহীন পদ্ধতি এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে মুঠোফোনের ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে সকল প্রশ্নের উত্তর দেবার জালিয়াতি বন্ধ করা হয়েছে।
একইসাথে সেটকোডহীন কিন্তু সিরিয়াল নাম্বারযুক্ত এইরকম প্রশ্নপত্রের অনেকগুলি সেট করতে হবে যাতে পরীক্ষার হলে একজন শিক্ষার্থী কোনোভাবেই তার প্রশ্নপত্রের ধরন বাইরের কাউকে জানাতে না পারে।
সমস্যা ৪, সমাধানঃ কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য অনেক আগে থেকেই লেখালেখি হচ্ছে। এরই পদক্ষেপ হিসেবে সর্বশেষ সরকারের পক্ষ থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিিয়া শুরুর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যা পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে সম্ভব হয়নি। এখানে কথা হচ্ছে, কোচিং সেন্টারগুলিকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা বা বন্ধ করার প্রয়োজন হয় তাহলে সরকার সরাসরি নীতিমালা বা আইন করে দিলেই হয়তো ভাল হবে।
যদিও এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোচিং সেন্টারগুলি সাধারণত দুই ধরনের হয়ঃ (১) বিশ্ববিদ্যালয় (বা অন্যান্য) ভর্তি কোচিং, (২) একাডেমিক কোচিং। এই কোচিং সেন্টারগুলি সরাসরি আইন বা নীতিমালা না করে কেবল ভর্তিপদ্ধতি পরিবর্তন করে আদৌ কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? কারণ অনেকে বলে থাকেন, সকল পরিবারের (বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত) পক্ষে শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও ঘরে বসে নিজ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ও অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতো তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করা অন্তত এই যুগে অনেক দুরূহ ব্যাপার। তাই শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে যান। এখানে কোচিং নির্ভরতার পিছনে এ যুগের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও বিদ্যালয়ের স্বল্প কার্যক্রমের শিক্ষাব্যবস্থা-ই দায়ী।
॥
ভতির্পদ্ধতি কোনোভাবেই দায়ী নয়। কারণ ভর্তিপদ্ধতিতে যত পরিবর্তনই আনা হোক, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তিযুদ্ধ এবং স্কুল কলেজের স্বল্প দক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা-ই শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের শরণাপন্ন করবে।
উলেখ্য, কোচিং সেন্টার যদি সরাসরি হস্তক্ষেপে বন্ধও করা হয়, তাহলেও কোচিং সেন্টারের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা হয়তো গৃহশিক্ষকের শরণাপন্ন হবে। অর্থাৎ ঘুরে-ফিরে একই কথা থাকছে।
পরীক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন (২০১৪ ব্যাচ) এর ভাষ্যে, “........ কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বাড়ি থেকে সপ্তাহে দুদিন কলেজে যেতাম। প্রথম তিন মাস পর দেখি আর ক্লাস হয় না। সবাই শিক্ষকদের বাসায় প্রাইভেট পড়ে। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হলো না। তাই বাধ্য হয়ে কলেজের আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে পড়াশুনা শুরু করলাম...........”।
(১৯অক্টোবর, ২০১৩ একটি দৈনিকের সংবাদে প্রকাশিত)
তাই প্রথম ও প্রধান সমাধান হওয়া উচিত স্কুল-কলেজ লেভেলে শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়ন, যাতে শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টার ছাড়া নিজেরাই এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
এবং ‘হয়তো’ কোচিং সেন্টারগুলিকে নীতিমালার মাধ্যমে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা। ‘হয়তো’- বলছি একারণেই কারণ উন্নত বিশ্বে কোচিং সেন্টারের আদলে Learning Centre দেখা যায় (উদাহরণস্বরূপ SAT, GRE, GMAT ইত্যাদি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য Learning Centre রয়েছে)।
শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নায়ন এবং শিক্ষার্থীদের হয়রানি রোধে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ বিভিন্ন সমাধানের কথা বলছেন এবং আগেও বলেছেন। যেমন: ড. জাফর ইকবাল স্যারের মতে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং অধ্যাপক নজরুল ইসলাম স্যারের মতে আমেরিকার আদলে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য অভিনড়ব SAT পরীক্ষা, যেটি পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকেই দেওয়া যাচ্ছে। তার মতে এই অভিনব পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলাকেন্দ্র থেকে নেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি ও হয়রানি কমে যাবে।
উলেখ্য এই লেখাটি তৈরীর সময় নাটোরে ভয়াবহ বাস দূর্ঘটনা ঘটে, যেখানে গুরুতর আহত হন রাবি ভর্তি পরীক্ষায়
অংশ নেওয়া কিছু শিক্ষার্থী। এছাড়াও আরো অনেক সমাধান থাকতে পারে। আমাদের উচিত একসাথে বসে এই সমাধানগুলির মধ্যে সবচেয়ে ভালোটি বেছে নেওয়া, যাতে সামাজিক (এইক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের) ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। তা না করে যদি পুরো সিস্টেমটিই (দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ) বাদ দিই, তবে তা হবে ‘মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা’র সমান।
ঢাবি কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমার মতে এর কারণে দু’টি সমস্যা তৈরি হতে পারে; একটি স্বল্পকালব্যাপী, অন্যটি দীর্ঘকালব্যাপী।
স্বল্পকালব্যাপী সমস্যাঃ এরই মধ্যে ২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আমরা আন্দোলন করতে দেখতে পাচ্ছি। যারা আগে থেকে জানত দ্বিতীয়বার তারা সুযোগ পাবে। সূত্র: একটি জাতীয় দৈনিক, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ইং; সম্মানিত ভিসি মহোদয়ের ভাষ্য, “যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন, তাঁদের অগ্রিম অভিনন্দন। যারা পারবেন না, তাঁদের আরেকবার সুযোগ থাকবে। ”
এই ব্যাচের যারা প্রথমবার ঢাবিতে চান্স পায়নি কিন্তু উচ্চবিত্তের সন্তান, তারা সহজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দেবে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের (বিশেষ করে কৃষক পরিবারের সুবিধাবঞ্চিত) মেধাবী শিক্ষার্থীরা অন্তত দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ হারাচ্ছে। ঢাবি’র দেখাদেখি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও তড়িঘড়ি এ ব্যবস্থা কার্যকর করলে ২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের প্রতি বড় ধরনের অবিচার করা হবে।
দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যাঃ ঢাবি’তে প্রচুর মেধাবী শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন এবং প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসেন, যারা সুবিধাবঞ্চিত এলাকা (গ্রাম), নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। শহরে বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীদের প্রথমবার ঢাবিতে পরীক্ষা দিতে এসে যে ধারণা হয়, পরীক্ষার্থী আব্দুলাহ
আল মামুনের (সূত্র: একটি জাতীয় দৈনিক,১৯/১০/২০১৪) ভাষ্য, “এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দেখি, সবাই কোচিং করার জন্য শহরে আসছে। কিন্তু প্রথমেই সে সুযোগ আমার হয়নি। অনেক কষ্ট করে বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে রেজাল্টের ১৭ দিন আগে আমি পাবনার একটি কোচিংয়ে ভর্তি হই। সেখান থেকে আমি প্রথম মেডিকেল, বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রদের সাথে পরিচিত হই। তাঁদের মুখে নানা রকম গল্প শুনে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেখান থেকে ফরম পূরণ করে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসি পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি আমার করুণ অবস্থা। সবাই একাধিক জায়গায় কোচিং করেছেন। কেউ কেউ আবার মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়েছেন। সবাই ঢাকার স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এবার পরীক্ষা দিচ্ছেন প্রায় ৮০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী। এসব দেখে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশা দূর হয়ে গেল। ”
ঢাবির পরীক্ষার জন্য শহরের শিক্ষার্থীরা যে কত বেশি প্রস্তুতি নেয় ও নেওয়ার সুবিধা পায় তা মামুনের দেওয়া তথ্যগুলি থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় মামুনের মত অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী ঢাকায় পরীক্ষা দিতে আসার আগ পর্যন্ত গ্রামে বসে কোনোভাবেই জানতে পারছে না ঢাবিতে পড়তে হলে প্রকৃতপক্ষে তাদের কত বেশি অধ্যবসায়ী হতে হবে।
আপাতঃদৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যা ছোট মনে হলেও আসলে তা নয়। অর্থনীতিতে ‘তথ্য অসামঞ্জস্য’ (Information Asymmetry) বলে একটি প্রসঙ্গ আছে; যেখানে বলা হয় শুধুমাত্র তথ্যের অভাবে বা ভুল তথ্যের কারণে একটি বাজারের বৈশিষ্ট্য উলেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। একইভাবে গ্রামের শিক্ষার্থী যাদের কাছে এই তথ্য নেই (যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধের তীব্রতা কত বেশি) তারা এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রথমবারে এবং এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র দু’মাস পরে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আদৌ কতটুকু সফল হবে সে বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন থেকে যায়। হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন চোখে না পড়লেও ভবিষ্যতে সম্ভবত ধীরে ধীরে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমতে থাকবে।
দ্বিতীয়বার ভর্তি বাতিলের এই সিদ্ধান্তে আমার মতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়ছে তুলনামূলকভাবে নিম্ন আয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের উপর। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময় এই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিটি-ই পরিস্থিতির শিকার হয়ে এলেও অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে যাতে এ বৈষম্য না হয় সে বিষয়টি পুনর্বিবেচেনা করে দেখা উচিত। সমস্যা নিরসনে আরো ভালো সমাধানে হয়তো আমরা পৌছতে পারব।
সবশেষে বলব, এই সিদ্ধান্ত শোনার পর আমার মনে হচ্ছিল, ঢাবিতে যেকোনো সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা খারাপ হলে মানোন্নয়ন পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে যদি হঠাৎ করে বলা হয়, “গত সেমিস্টার ফাইনালে আপনার ফলাফল যাই হোক না কেন, আপনি আর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে পারবেন না”, তবে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? বা ঢাবির পাস করা কোনো শিক্ষার্থী যিনি গত বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন (এবং ভবিষ্যতেও শর্ত অনুযায়ী দিতে পারবেন), তাকে যদি হঠাৎ করে এখন বলা হয়, “গত বিসিএসটিই আপনার জন্য শেষ সুযোগ ছিল”, তাহলে কি তিনি তা মেনে নিতে পারবেন? ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অবস্থানে নিজেরা না পড়লে আমরা বুঝব না তাদের স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট কত তীব্র, কতো অসহনীয়, কতো দু:স্বপ্নময়।
প্রায় সাত থেকে আট লক্ষ শিক্ষার্থীর (২০১৪ ব্যাচ) জীবনযুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ভর্তিপরীক্ষা অন্তত ২০১৬ সাল থেকে কার্যকর করলে ভালো হবে। তাহলে ২০১৪ ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থীরা রক্ষা পাবে এবং ২০১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও একবছর আগে থেকে সাবধান হতে পারবে। হয়তো সবচেয়ে ভালো হবে, শিক্ষাবিদরা সবাই একসাথে বসে আরো ভালো কোনো সমাধান যদি বের করতে পারেন। আমরা সেদিকেই তাকিয়ে আছি।
এইচ এম এ শাহরিয়ার
শিক্ষার্থী,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
101shahriar@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪