ঢাকা: শাজাহান খড়গে এবার চাকরি হারালেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (প্রোভিসি) ড. এ এন এম মেশকাত উদ্দীন।
দুর্নীতি আর লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় দেশের অন্যতম বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসিকে মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়।
এর আগে সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহানের লুটপাটের বিরোধিতা করে এ পর্যন্ত ৩৭ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন। এমনকি শাজাহানের হাতে নারী লাঞ্ছনারও ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারির মতো অপকর্মের কারণে ডুবতে বসা বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই।
তাদের নানা অরাজকতায় শুরু হয়েছে আবারও অস্থিরতা। ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ। বিশেষ করে প্রোভিসিকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তের পর ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অভিভাবক মহলেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ইচ্ছামতো যাকে খুশি তাকেই নিয়মবর্হিভূতভাবে চাকরিচ্যুত করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য শাজাহানের রোষানলে যিনি পড়েছেন, তাকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছে। তার দুর্নীতি, জালিয়াতি আর ছাত্রদের অর্থ লুটপাটে সহযোগিতা যারা করেননি, তাকেই বিভিন্ন কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কাছেও অভিযোগ করাহ হয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্তও হয়েছে। এর বাইরে একজন জনপ্রিয় শিল্পী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আসা শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, শিক্ষামন্ত্রী ও ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, শাজাহানের স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিজের তৈরি আইন প্রতিষ্ঠা করেছেন। জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগও রয়েছে শাজাহানের বিরুদ্ধে। ফলে ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারছেন না কেউ।
জানা যায়, ট্রাস্টি বোর্ড ও ভিসি নানা কাজের সিদ্ধান্ত নিলেও মূলত নেপথ্যে থাকেন শাজাহান। আগে থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে রাখেন বোর্ড ও ভিসির কাছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অমান্য করে প্রোভিসি ড. মেশকাত উদ্দীনকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ভিসি ও বোর্ড অব ট্রাস্টির নিয়মবহির্ভূত বিভিন্ন সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করায় তাকে কৌশলে বরখাস্ত করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী চ্যান্সেলর সুস্পষ্ট কোনো কারণে বোর্ড অব ট্রাস্টির সুপারিশক্রমে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসিকে অপসারণ করতে পারবেন।
তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান করতে হবে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করেই ড. মেশকাতকে মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়। এমনকি তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ড. মেশকাত উদ্দীন বলেন, ডিগ্রি জালিয়াতির অভিযোগ এনে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমার পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) অর্জন করি। ডিবিএ ডিগ্রি ও পিএইচডি ডিগ্রি সমমানের। বাংলাদেশে ডিবিএ শব্দটি প্রচলিত নয়। তাই জীবনবৃত্তান্তে পিএইচডি উল্লেখ করেছি। আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচারে লিপ্ত। বরখাস্তের আগে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের লঙ্ঘন। চ্যান্সেলর ব্যতীত প্রোভিসিকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা কারও নেই বলে তিনি দাবি করেন।
আরো জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় চলছে একক সিদ্ধান্তে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সাবেক চেয়ারম্যান শাজাহানের সিদ্ধান্ত অধস্তন শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দেন ভিসি ও বোর্ড অব ট্রাস্টি। যেসব কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ এবং শিক্ষা কারিক্যুলাম পরিবর্তন হওয়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রে সেসব মানা হয়নি।
বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগের ডিন ও চেয়ারম্যান নিয়োগ পছন্দের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হচ্ছে। যখন-তখন নোটিস ছাড়াই শিক্ষক, কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রোভিসি ভিসি ও বোর্ড অব ট্রাস্টির সিদ্ধান্তে সমর্থন না দেওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়।
এর আগে আকস্মিকভাবে গত ৭ নভেম্বর ড. মেশকাত উদ্দীনকে সব ধরনের দায়-দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনায় উঠে আসে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। ট্রাস্টি সদস্য শাজাহানের নারী কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হওয়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে নারী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে। শাজাহানের এহেন কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীরাও ক্ষুব্ধ। রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাত্রদের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন শাজাহান।
একজন অভিভাবক আক্ষেপ করে বলেন, অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বোর্ড জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা লুটপাট করে, মাস্তান নিয়ে চলাফেরা করেন, তারা কীভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন। তাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। তার মতো বহু অভিভাবক সন্তানদের নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের অনেকেই বলেছেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নামে শাজাহান এটিকে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। তার স্বেচ্ছাচারিতায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের কয়েকশ কোটি টাকা ইচ্ছামতো তুলছেন, খরচ করছেন।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্র-মতবাদ ছড়ানো ও তাদের ‘জঙ্গিবাদ-এ উদ্বুদ্ধ করার গোপন তৎপরতায় কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা জড়িত বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের গ্রেফতার, ক্যাম্পাসে শিবির ও হিযবুত তাহরিরের কর্মকাণ্ডের অভিযোগের পর ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকারীর তালিকায় চলে আসে প্রতিষ্ঠানটির উগ্রবাদী পাঁচ ছাত্রের নাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভিসি অধ্যাপক আমিনুদ্দিন সরকারের দেশপ্রেমেরও অভাব রয়েছে। কয়েকমাস আগে রাজধানীর ‘সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাব’-এর এক অনুষ্ঠানে ১৬ ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উল্লেখ করেন।
এছাড়া ‘আমরা বিদেশে গিয়ে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি’ বলে বক্তব্য দিলে এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তার বক্তব্যকে দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে বক্তব্য থামাতে বলেন। সে সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন ভিসি আমিনুদ্দিন।
এর বাইরেও এক ভারতীয় নাগরিকের কাজের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪