যদি প্রশ্ন করা হয় একটি আকাশ চুম্বী উচুতল ভবন নির্মাণ করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? একবাক্যে জবার আসবে মজবুত ভিত্তি, নয় কি? যদি প্রশ্ন করা হয় “একটি আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন জাতি” তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? বোধ হয় সবচেয়ে সঠিক জবাব হওয়া উচিৎ নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা।
শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি তথা প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যদি ভবিষ্যত প্রজন্মের মনমগজে ও ধ্যানে জ্ঞানে আদর্শ, নীতি নৈতিকতা, সততা, আচরণগত অভ্যাস, দেশ প্রেম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারে তা হলে কখনোই আদর্শবান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর শিক্ষার হার বেড়েই চলেছে। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে আমরা যা আশা করি (যেমনঃ ভাল ব্যবহার, ভাল সেবা) তা আমরা কতটুকু পাই এর জবাব আমরা সবাই জানি। ফলে শতকরা হার বাড়ানো শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের অদূর ভবিষ্যতে কি উপহার দেবে তা ভাববার বিষয়।
বর্তমান বাস্তবতায় এই লিখার মাধ্যমে সংক্ষিপ্তভাবে আদর্শ জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে যেসব নিয়ামকের ভূমিকা রয়েছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এবং কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার অতীত ও বর্তমান
এখন হতে ২০-২৫ বছর আগে যখন আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতাম তখন ছাত্র/ছাত্রীর উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। ক্লাশ প্রতি গড়ে ৪০-৫০ জন। দারিদ্র, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা, নারী শিক্ষা সম্পর্কে কুসংস্কারসহ নানাবিধ সামাজিক প্রতিবদ্ধকতা ছিল এর মূল কারণ। গত দুই দশকে এসব ঋনাত্মক কারণ দূর করে বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের উপস্থিতির হার এখন লক্ষণীয়। তাছাড়া সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী উদ্যোগ (যেমনঃ বিনামূল্যে বই বিতরণ, টিফিনের ব্যবস্থা, বিনা বেতনে অধ্যায়ন ইত্যাদি) বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের গমনের হার এবং উপস্থিতির হার বাড়াতে সহায়তা করছে। মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে দেশে শিক্ষার হার বেড়ে চলছে এটি সত্য। তবে আদর্শ জাতি গঠনের জন্য কিংবা সেবাধর্মী মৌলিক মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন যে ধরনের মানুষ প্রয়োজন তা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বেরিয়ে আসছে বলে মনে হয় না।
উন্নত বিশ্বের কোন দেশে সেবা গ্রহণের অভিজ্ঞতা আছে এমন যে কেউই স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশের খুব কম শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে সেই ব্যবহার বা সেবা পাওয়া যায়। যে ছেলেটি পিয়ন বা অফিস সহায়কের চাকরি নিয়ে সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছে সে অবশ্যই কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে।
প্রশ্ন হলো, এই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কি তাকে শিখিয়েছে- কিভাবে সেবা প্রত্যাশী মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, জনগণের প্রতি তার কি দায়বদ্ধতা, তার বেতন কার টাকায় কিভাবে হয়। যদি কারও অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে অনুরোধ রইল বাংলাদেশের কোন সরকারি/বেসরকারি অফিসে গিয়ে এদের সাথে কথা বলুন।
মনে হয় না কেউ সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরবেন। তাহলে যে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের মাঝে নুন্যতম সৌজন্যবোধ, সুন্দর আচরণ, মানবতাবোধ কিংবা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে না সেই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে আর যাই হোক আদর্শ বিনয়ী জাতি গঠন করার স্বপ্ন আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মানুষের কাছে মানুষের সুন্দর ব্যবহার, বিনয়, সৎ পরামর্শ একান্তই কাম্য। মানুষের একান্ত চাওয়া এই বিষয়গুলো তখনই সম্ভব যখন আমাদের জাতি গঠনের ভিত্তি স্তর তথা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন মানুষ পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন করতে শিখবে। এসব নৈতিক মানসম্পন্ন আদর্শ জাতি গঠনে যে সব বিষয়ে অপরিহার্য তার কয়েকটি বিষয়ে সংক্ষেপে নীচে আলোচনা করা হলঃ
(ক) নৈতিক মান সম্পন্ন আদর্শ শিক্ষক
জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার তৈরির জন্য যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন- আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আদর্শ নাগরিক তৈরির জন্য একজন আদর্শ শিক্ষকের বড়ই প্রয়োজন। যার চলনে বলনে আচরণে ও জ্ঞান গরিমায় অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় খুবই প্রয়োজন।
(খ) শিক্ষার সুন্দর পরিবেশঃ
পাঠ্য পুস্তক ছাড়াও শ্রেণি কক্ষে অবস্থিত বিভিন্ন শিক্ষামূলক ছবি, পোস্টার বা উপকরন দিয়েও কোমলমতি ছেলে মেয়েদের অনেক কিছু শেখানো যেতে পারে। প্রাত্যহিক জীবনের কাজ গুলো নিয়ম করে প্রাক-প্রাথমিকে শিখানো যেতে পারে। যেমন: কিভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কিভাবে হাত ধুতে হয়, টয়লেট ব্যবহারের নিয়ম, নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস গঠন ইত্যাদি।
(গ) উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগনের দায়িত্বঃ
প্রত্যেক উপজেলায় একজন শিক্ষা অফিসার এবং একাধিক সহকারী শিক্ষা অফিসার রয়েছেন। যাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করা। এসব কর্মকর্তাদের উচিত কর্মস্থলে নিয়মিত অবস্থান করে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য চিন্তা গবেষণা করে প্রতি ছয় মাসে অন্তত ১টি Innovative ধারনার জন্ম দেওয়া এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহন করা। শুধু কোটা পূরণের জন্য বিদ্যালয় পরিদর্শনে না গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হওয়া।
(ঘ) ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস জানানো:
জাতির ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে জাতি তার ইতিহাস জানে না সে জাতি সুন্দর ভবিষ্যতও রচনা করতে পারে না । তাই প্রাথমিক শিক্ষাস্তরেই জাতির গৌরবময় অতীত ইতিহাস নবপ্রজন্মকে জানাতে হবে। যে লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ দেশের জন্ম তা তাদের জানাতে হবে, তবেই না তাদের মঝে দেশের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হবে।
(ঙ) দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনে প্রাথমিক শিক্ষা:
শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটানো। শিক্ষাহীন একজন মানুষ ধনী গরীব, নারী পুরুষ, কালো-সাদার যেভাবে পার্থক্য করে, একজন শিক্ষিত মানুষের সেভাবে পার্থক্য করার কথা নয়। সবাইকে মানুষ হিসেবে ভাবার কথা, আরও বেশী জনমুখী হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যিনি, যতবেশী শিক্ষত তিনি ততবেশী রাশভারী, ততবেশী জনগণ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, পারলে দরজা বন্ধ করে অফিস কক্ষে বসে থাকেন। যদি তাই হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ হয়েছেন তা তার দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি।
(চ) মেধাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন:
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদই অন্তরে। একজন শিশু বড় হয়ে আগামী দিনে সে কি হবে তা কেউ জানে না। তবে অফুরন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে তার ভেতরে।
শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, কেউ গণিতে খুব ভাল, কেউবা সাহিত্যে, কেউ বিজ্ঞানে, কেউবা খেলাধুলায়। এসব শিশুর মেধা ভিত্তিক প্রবণতা নির্ধারণ করে ছোট বেলা থেকে নার্সিং করে পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হলে জাতি অনেক বেশি উপকৃত হবে।
(ছ) জনসেবার মান উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষা
বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই চালু আছে বাংলাদেশে। শুধু তাই নয় এখন বৃত্তি এবং টিফিনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পেছনে বিনিয়োগকৃত এই অর্থ কোথা থেকে আসে? এবং যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের পড়াশুনার ব্যয়ভার মেটানো হয়, সেই জনগণের প্রতি তাদের কি দায়িত্ব ও কর্তব্য? তা কি তাদের বুঝানো হয়? এই বিষয়গুলো প্রাথমিক স্তরেই তাদের বুঝাতে হবে। তা হলে বড় হয়ে তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শিখবে এবং জনগণের প্রভূ না হয়ে সেবক হতে শিখবে।
(জ) বাস্তব ভিত্তিক জীবন গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরটি এমন হওয়া উচিত যাতে করে শিশুরা শৈশবেই বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তবমুখী জ্ঞান লাভ করে। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিকে এমন পাঠ্য পুস্তক দিতে হবে যেখানে ছবি দেখে তারা অনেক কিছু জানতে পারবে এবং শিখতে পারবে। একইভাবে তাদেরকে বিভিন্ন (যেমনঃ রাস্তায় চলাচলের নিয়ম, দুর্যোগকালীন করণীয়, আত্মরক্ষার কৌশল, বিভিন্ন জীব জন্তুর সাথে পরিচয় ঘটানো প্রভৃতি) বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
একটি উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবেনা। তাই বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার যে সমস্যা রয়েছে তা দ্রুত চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রচলিত নিয়মে হয়তো শিক্ষার হার বাড়বে, মানুষের মাথা পিছু আয় বাড়বে, কিন্তু সেবাধর্মী নৈতিকতা সম্পন্ন উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্ন কখনোই পুরণ হবে না। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে।
** প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন: সমস্যা ও করণীয়
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪