ঢাকা: পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বাড়লেও ২০১৪ সালে প্রশ্ন ফাঁসে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হয়েছে সব ক’টি পাবলিক পরীক্ষা। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী, অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা থেকে শুরু করে এসএসসি-এইচএসসি’র সকল পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রীদ্বয় স্বীকার না করলেও বছরজুড়ে চার পাবলিক পরীক্ষার তিনটিতেই প্রশ্ন ফাঁসের গুরুতর অভিযোগে শিক্ষাবিদদের সমালোচনায় মুখ পুড়েছে সরকারের।
সর্বশেষ প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নই ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
একটি স্থগিত করে সব অভিযোগের বৈতরণী পার!
চলতি বছরে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা স্থগিত করে নতুন করে নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র এবং গণিত দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পেলেও তা বাতিল করা হয়নি।
এছাড়াও ইংরেজি প্রথম পত্র, পদার্থ, রসায়নসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষার প্রথম দিন শেরপুর ও চট্টগ্রামে কয়েকজনকে আটকও করা হয়।
পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, ফলাফলে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো প্রভাব পড়েনি। আগের তুলনায় সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের অনেক বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষকদের ২৩ ধরনের ক্লাস নেয়া হয়।
পরীক্ষার রাতে ভরসা ফেইসবুক
চলতি বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক ও ইবেতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়েরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। ফেইসবুকে পরিচিত কয়েকটি পেইজ থেকে সাজেশনের নামে প্রশ্নপত্র হুবহু তুলে দেওয়া হলেও সে সব পেইজ এখনও চলছে। পরীক্ষার আগের রাতে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলের চেয়ে ফেইসবুক-ইন্টারনেটেই মগ্ন ছিলো বেশি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস
চলতি বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৫২টি প্রশ্নের মধ্যে ৪১টি প্রশ্নই মিলেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে। ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ লোখের বেশি শিক্ষার্থী।
ইতিহাস এক বছর আগের
২০১৩ সালেও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সে সময় শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ জানিয়েছিলেন, ইংরেজিতে ৮০ শতাংশ এবং বাংলায় ৫০ শতাংশ প্রশ্নপত্রের মিল পাওয়া গেছে। তবে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি, শাস্তিও নেওয়া হয়নি কাউকে।
ওই বছরেরই জেএসসি-জেডিসির প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। পরীক্ষার ফলের পর প্রশ্ন ওঠে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণেই আগের বছরের তুলনায় পাস এবং জিপিএ-৫ বেড়েছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ঐচ্ছিক বিষয়ের নম্বর যোগ হওয়ায় জিপিএ-৫ বেড়েছে।
সুপারিশ আছে, বাস্তবায়ন শূন্য!
প্রশ্ন ফাঁসরোধে দুই কমিটির একাধিক সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
চলতি বছর অনুষ্ঠিত এইচএসসি ও গত বছরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে প্রশ্ন ফাঁসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রশ্ন তৈরি ও বিতরণে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করে।
গত বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বাংলা বিষয়ের ৫৩ শতাংশ এবং ইংরেজির ৮০ শতাংশ প্রশ্ন ফাঁস হয় বলে তদন্তে প্রমাণ হয়। তবু পরীক্ষা দু’টি বাতিল করা হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্ন প্রণয়নে ‘আমূল’ পরিবর্তনের সুপারিশ করে বিজি প্রেসের কাগজ শনাক্ত করার জন্য সফটওয়ার ব্যবহার করতে বলা হয়।
এছাড়া এইচএসসির ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পর উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটিও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রোধে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রশ্ন প্রণয়ন ও সরবরাহের সুপারিশ করে।
সফটওয়ার নিয়ন্ত্রিত প্রশ্ন প্রণয়ন এবং একটি ‘প্রশ্নব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করে এ পদ্ধতিতে ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড, বায়োমেট্রিক্স ও ইউজার একসেস কার্ড- এ তিন স্তরের নিরাপত্তার সুপারিশ করে কমিটি।
কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেই। এসব সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
শুধুই আশ্বাস...
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় আগামীতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণ করা হবে বলে জানান গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। একই কথা বলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য না করে এক বছরে নিজের মূল্যায়ন সম্পর্কে গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, এই সময়ে প্রাথমিক শিক্ষার অনেক অগ্রগতি রয়েছে। আমরা অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস রোধে মনিটরিং কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বার বার বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস করে কেউ রেহাই পাবে না। প্রশ্ন ফাঁসের ‘আগুনে’ হাত দিলে পুড়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪