ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

কামল‍া খেটে পেট চলে শিক্ষক তসলিমের

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫
কামল‍া খেটে পেট চলে শিক্ষক তসলিমের ছবি : শোয়েব মিথুন /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বুধবার দিবাগত রাতে ঘড়ির কাঁটায় দুইটা ছুঁইছুঁই। তখনও অর্ধশতাধিক শিক্ষক এমপিওভুক্তির দাবিতে অবস্থান নিয়ে রয়েছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে।

কেউ কম্বল গায়ে জড়িয়ে কেউ মশারি টাঙিয়ে অবস্থান করছেন সেখানে। অনেকে কয়েল জ্বালিয়ে সড়কের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।

একদিকে মশার কামড় অন্যদিকে যানবাহনের হর্নের শব্দে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠছেন শিক্ষকরা।

মশার কামড় ও যানবাহনের হর্নে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় উঠে বসেছেন শিক্ষক তসলিম উদ্দিন (৫৫)। মুখভর্তি সাদা দাড়ি-গোঁফ। কপালে-চোয়ালে বয়সের ভাঁজ। ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে হতাশাও।
 
প্রায় ১৫ বছর যাবত বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকাইল উপজেলা হোসেনগাঁও দাখিল মাদ্রাসায়। এমপিওভ‍ুক্তির আশায় আশায় ১৫ বছর সহকারী শিক্ষক হিসেবে পার করে দিয়েছেন তিনি। তিন ছেলে-মেয়েসহ ৬ জনের পরিবার তসলিম উদ্দিনের। শিক্ষকতায় বেতন না এলেও পেট তো চালাতে হবে, তাই শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কামলা খাটেন তিনি।
 
তসলিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছি। ৬ জনের পরিবার। তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া আমার দায়িত্ব। তাই পরের জমিতে কামলা খাটি। ধানের সময় জমি থেকে ১ মণ ধান সংগ্রহ করে দিলে বিনিময়ে ৬ সের পায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি ক্ষেত-খামারে সব কাজই করতে হয়।
 
আরেক হতভাগা শিক্ষক মজিবর রহমান। অভাব যেন তার সঙ্গী জন্ম থেকেই! রানীশংকাইল উপজেলায় ৮ শতক খাস জমিতে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। তিনি হোসেনগাঁও মাদ্রাসায় ১৬ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। বাবা হযরত আলী ভিক্ষাবৃত্তি করে সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুললেও অভাব অনটন থেকে ‍মুক্তি মেলেনি। শিক্ষক মজিবর রহমানের পিতা অভাব অনটনের মধেই ২০০১ সালে মারা যান। বর্তমানে চার ছেলে-মেয়ে ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে যেন অকূল-পাথারে পড়েছেন এই শিক্ষক।
 
গভীর রাতে প্রেসক্লাবে অবস্থান প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই দুই চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে নোনা জল। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষক মজিবর বাংলানিউজকে বলেন, বাবা ভিক্ষা করে পড়াশুনা করিয়েছে, বাবার স্বপ্নপূরণ করতে ‍পারিনি। বেকার হয়ে বৃদ্ধ মায়ের স্বপ্নও পূরণ করতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আমার মাদ্রাসা যেন এমপিওভুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের মায়ের মতো, তিনি সন্তানের কষ্ট না দেখলে কেউ দেখার নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে হাত জোড় করে আবেদন করছি।
 
৬ জনের সংসার কিভাবে চলে এমন প্রশ্নের জবাবে মজিবর বলেন, অন্যের বাড়িতে বাচ্চা পড়িয়ে দিনে চলে।
  
একেক জন শিক্ষকের জীবনের গল্প যেন কষ্টের মহাকাব্য। তাদের মধ্যে অন্যতম কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার এ এম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজিজুল হক। বয়স ৪৫ বছর পেরিয়েছে। ৫০ শতাংশ চুল সাদা। তব‍ুও বয়স লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা। কানের পাশ দিয়ে দুই একটি চুল কালো কলপের মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে।
 
এই বয়সে ঘর সংসার থাকার কথা কিন্তু বিনা বেতনের শিক্ষকতার জন্য বিয়ে পর্যন্ত করার সাহস পাননি শিক্ষক আজিজুল হক। ১০ বছর আগে তিন লাখ টাকা দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে একটি কড়িও আয় করেননি তিনি।
 
আজিজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, পিতা-মাতার সামনে মুখ দেখাতে কষ্ট হয়। আর কতদিন তাদের টাকায় চলবো। ১০টি বছর বাপের টাকা খরচ করে শিক্ষকতা করছি। নিজে বিয়েটা পর্যন্ত করতে পারিনি। তাই সরকার আমাদের দিকে যেন একটু খেয়াল করে।
 
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের শিক্ষকরা ২৫ দিন ধরে অবস্থান নিয়েছেন ঢাকায়। এর আগে এমপিও’র দাবিতে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে টানা অবস্থান করেছেন।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে নড়বেন না। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মো. ইশারাত আলী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তাপস কুমারের নেতৃত্বে শিক্ষকরা এ আন্দোলন করছেন।
 
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের প্রভাষক আশরাফুল হক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও ১৬ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন তিনি।
 
প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হতাশায় আচ্ছন্ন এই শিক্ষক।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫
এমআইএস/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।