ঢাকা: পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের নতুন পদ্ধতিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই পদ্ধতি যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে ততোই মঙ্গল হবে।
পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষাবিদরা নিয়োগ পরীক্ষার নম্বর বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে দ্রুতই সরকারি কর্ম কমিশনের আদলে একটি কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালা-২০০৬’র সাম্প্রতিক সংশোধনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে মতবিনিময় সভায় এমন মত দিয়েছেন তারা।
বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এই মতবিনিময় সভায় শিক্ষাবিদ ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১১ নভেম্বরের এক আদেশে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগে ব্যবস্থাপনা কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে গত ২২ অক্টোবর তারিখ দিয়ে ওই বিধিমালার সংশোধনী প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন’র অধীনে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মেধা তালিকা তৈরি করে শিক্ষক নিয়োগ দেবে বলে সংশোধিত বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্দেশনাটি ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালা, ২০০৬’ এর অধিকতর সংশোধনীর গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু সংসদ সদস্যরা নতুন নিয়মের বিরোধী।
পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়োগ হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ হয় বলে মতবিনিময় সভায় জানান শিক্ষাবিদরা। এতে মানসম্পন্ন শিক্ষকও তৈরি হয়না।
নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দুর্নীতিসহ অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেও যারা চাকরি পাবেন না তাদের কি হবে- সে বিষয়টিও মাথায় রাখার জন্য বলেন এই শিক্ষাবিদ।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, একটি স্কুলে শিক্ষক ভালো হয়ে গেলে স্কুল ভালো হয়ে যায়। ভালো শিক্ষকের উপর জোর দেন আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, নৈতিকতা সিলেবাসে ঢোকানো হচ্ছে, আর প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে। অযোগ্য মানুষ শিক্ষক হয়েছে, যোগ্য মানুষ শিক্ষক হতে পারছেন না। যিনি টাকা দিয়ে ঢোকেন তিনি ওই টাকার একশ’ গুণ তোলেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর রশীদ বলেন, একজন এমপি চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি, অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের স্ত্রী-শ্যালকদেরও সভাপতি পদে বসান। শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য হচ্ছে, এটা বড় সমস্যা, এর দায় এমপিরা এড়াতে পারেন না। সুতরাং নতুন পদ্ধতি বাণিজ্য ঠেকাবে।
নতুন পদ্ধতিতে নিয়োগ বাণিজ্যে ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এই পদ্ধতিকে স্বাগত জানান অধ্যাপক জাফর ইকবাল। তিনি সংশোধিত বিধিমালা ওয়েসবাইটে প্রকাশ করে জনমত সংগ্রহ করার পরামর্শ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, শুধু নিয়োগের ক্ষেত্রে না, ভর্তিতেও বাণিজ্য হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে সেক্স রিলেটেড কনভারসেশন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্কুল থেকে কি শিখছে? কি ধরনের শিক্ষক চাইছে, অভিভাবকদের এসব বিষয়ে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারখানা হচ্ছে কি না- সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এনামুল হক ভালো প্রার্থী বাছাইয়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসের নম্বর ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ বা ৭০ শতাংশ করার দাবি জানান। অনেক সময় কম বিক্রিত পত্রিকায় শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্রীয়ভাবে মাসিক বুলেটিন বের করার পরামর্শ দেন।
শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্যদের সংস্কারের দাবি জানান।
সামলা নাসিরউদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্যদের সভাপতি আতাউল্লাহ মন্ডল অভিযোগ করেন, হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ৪০ শতাংশ দুর্নীতি হয়। শুধু সভাপতিরা দুর্নীতি করেন না।
আরেকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্যদের সভাপতি নুরুল ইসলাম নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ দিলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন।
নতুন এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারি জাতির জন্য ততো মঙ্গল উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা সরকারের নতুন উদ্যোগকে সমর্থন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আফসারুল আমীন নতুন উদ্যোগকে সুন্দর ও বাস্তবমুখী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, নিয়োগের জায়গায় বারবার উঠে এসেছে দুর্নীতি। যিনি পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর গুরুত্ব দেন আফসারুল আমীন।
‘দুর্নীতি কি শুধু সংসদ সদস্যদের কলেজে হচ্ছে? বাকি কলেজগুলোতে কি হচ্ছে না? সেগুলো কি ধোঁয়া তুলশি পাতা, প্রশাসন, ডিসিরা নাই? সেখানে কী হচ্ছে?’
তবে মেধাসম্পন্ন শিক্ষকদের নিয়োগে প্রার্থী যে ইউনিয়নে সে ইউনিয়নে নিয়োগ দিলে ভালো হয় বলে মনে করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ৭৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ জানান, এমপিও পাচ্ছেন ২৮ হাজার ৩৮৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।
এমপিও বাবদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বছরে আট হাজার ২৫০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়; যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটের ৭০ শতাংশ।
এ পর্যন্ত ছয় লাখ প্রার্থী শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তাদের মধ্যে ৬৪ হাজার ৩২২ জন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষকের শুরু থেকে কর্মজীবনে জঞ্জালমুক্ত করতে সহায়তা করবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা সেই ব্যবস্থা করতে চাই। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার গুণগত মান অর্জন, সেজন্য প্রয়োজন গুণগত শিক্ষক।
যিনি শিক্ষক হবেন তার নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা দূর করে দিতে হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে মন্ত্রী জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, জবাবদিহিতা আনতে শিক্ষাবিদদের মতামত নেওয়া হয়েছে। সংশোধনীতে শিক্ষাবিদরা সবাই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। বিধিমালা সংশোধনের শেষ, এখন খুব শিগগিরই নতুন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ শুরু হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এমআইএইচ/জেডএস
** শিগগিরই নতুন পদ্ধতিতে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ: শিক্ষামন্ত্রী