ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ভারতেই ছাপা হবে অর্ধেক!

আসছে নিম্নমানের বিদেশি পাঠ্যবই

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
আসছে নিম্নমানের বিদেশি পাঠ্যবই

ঢাকা: প্রি-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজের বড় অংশই এবার চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করে প্রায় অর্ধেক বইই ছাপা হবে ভারতে।

টেন্ডারের সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানও পাচ্ছে বই ছাপার কাজ।

 

বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপবে বলে অভিযোগ করেছে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছে, বিদেশ থেকে নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপিয়ে আনা হলে বিকাশমান দেশীয় মুদ্রণ শিল্প ধ্বংসের দিকে চলে যাবে।

 

এদিকে প্রাইমারি টিচার্স গাইড ছাপার কাজ ইতোমধ্যেই চলে গেছে ভারত ও চীনের হাতে। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশ দু’টি ৬০ লাখ ১ হাজার গাইড ছাপিয়ে দেবে।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষে কারিগরি ও প্রাইমারি টিচার্স গাইডসহ ৩৩ থেকে ৩৫ কোটি হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এর মধ্যে প্রি-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের ১১ কোটি ৫৭ লাখ বই ছাপা হবে। এজন্য ৯৮টি লটে ভাগ করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে সরকার। এ ৯৮টি লটের মধ্যে ৬৩টিতেই সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। বাকি মাত্র ৩৫টি লটে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৮টিতে ভারত, ৮টিতে চীন ও ৭টিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। আবার ভারতের ৪৮টি লটের মধ্যে পিতামব্রা বুকস প্রা. লি. একাই ৪২টিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এছাড়া ভারতের আরও ৩টি প্রতিষ্ঠান ৬টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. হুমায়ুন খালিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দরপত্র দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাদের কাজ দেওয়া হবে তা টেকনিক্যাল ইভ্যালুয়েশন কমিটি বিবেচনা করছে। কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। গত বছর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করেছিল। তখনো আমরা সন্দিহান ছিলাম যে, তারা এ রেটে কাজ করে দিতে পারবে কি-না। কিন্তু তারা কাজ করেছিল’।

গণশিক্ষা সচিব আরও বলেন, ‘গত বছর যারা খারাপ মানের কাজ সরবরাহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে। কেউ কেউ ভালো কাজও করেছে। তাই এখনই বলা যাবে না যে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মানের কাজ করতে পারবে না। বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে, তাদের যোগ্যতা প্রমাণিত হলে অফিসিয়াল হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখা হবে। বাজারমূল্য যাচাই-বাছাই করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে’।

সূত্রমতে, ভারতের পিতামব্রা বুকস ৪২টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এনসিটিবি’র একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পিতামব্রা যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে, তার মধ্যে একটি জাল সনদও রয়েছে। পিতামব্রা ভারতের নামকরা প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে এনসিটিবি’র বই ছাপার অভিজ্ঞতার যে সনদ জমা দিয়েছে তা জাল বলে অনেকটাই নিশ্চিত এনসিটিবি।

আগের চেয়ারম্যানের বরাতে তারা এ জাল সনদ জমা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি তোফায়েল খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেশি মুদ্রণ শিল্প ধ্বংস হবে ওইসব বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে পাঠ্যবই ছাপার কাজ দিলে। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সংবাদ সম্মেলন করবো। দেশীয় ‍মুদ্রণ শিল্পকে বাঁচাতে শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেবো। পিতামব্রা নামে ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে এনসিটিবি’র বই ছাপার অভিজ্ঞতার যে সনদ জমা দিয়েছে তা জাল। আমরা প্রয়োজনে দুদকের আশ্রয় নেবো’।

এনসিটিবি’র বর্তমান চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ‘কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করলেই কাজ পাবে এমনটা নয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির আনুষঙ্গিক অন্য যোগ্যতাও থাকতে হবে। কাজের অভিজ্ঞতা, সঠিক সনদসহ অন্য শর্তগুলো পূরণ করলেই যোগ্য দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হবে। যোগ্য দরদাতাদের মধ্যে যারা সর্বনিম্ন রেটে দরপত্র দাখিল করেছেন, তাদেরই কাজ দেওয়া হবে’।

‘অনেকেই কম রেটে দরপত্র দাখিল করেছেন। তবে তাদের অনেকেরই বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই বা আমরা যে শর্তগুলো উল্লেখ করেছি, সেগুলো পূরণ করছে না। সেক্ষেত্রে তাদের কাজ দেওয়া হবে না’।

গত বছর প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার পুরো কাজ পেয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এবার বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি দাম উল্লেখ করেছে। যেমন গত বছর প্রতি ফর্মা বই ছাপার খরচ তারা উল্লেখ করেছিল, ১ টাকা ৫৫ পয়সা। এবার সে খরচ ধরা হয়েছে ২ টাকা ২৭ পয়সা।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেস মালিকদের অভিযোগ, বই ছাপার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দেশের শুল্কসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তা পায় না। বাংলাদেশের কাগজ রফতানি থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্র রফতানিতে ৬১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। ভারতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা প্রয়োজন হয় না।

দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, ভারত থেকে যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে আনা হয় তা আমদানিকৃত পুস্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো এনসিটিবি। ভারত থেকে আনা বইয়ের ক্ষেত্রে এনসিটিবি ১২ শতাংশ শুল্ক দেয়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে এ শুল্ক দিতে হলে তাদের বই ছাপার খরচ আরও অনেক বেশি পড়তো। তাছাড়া দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি থেকে কাজ পেলে তার ওপর ৫ শতাংশ ট্যাক্স কেটে রাখা হয়।

এসব কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়। এছাড়া সরকার সরাসরি বিদেশ থেকে বই আমদানি করার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কম দামে যেমন বই দিতে পারছে, ঠিক তেমনি বইয়ের মানও নিম্নমানের হবে বলে মনে করছেন দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকরা। কারণ, তাদের কাগজ আমদানি-রফতানি করতে হয় না। নিজেদের নিম্নমানের কাগজ দিয়েই ছাপার কাজ করবে তারা।    

অভিযোগ করে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি তোফায়েল খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কম দামে নিম্নমানের বই বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে ছাপানোর প্রক্রিয়া চলছে। ফলে একদিকে আমাদের শিশুরা যেমন নিম্নমানের বই পাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারও রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না’।
 
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির বিদায়ী সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাতও বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যে মূল্যে বিডিং করেছে, তাতে কোনোভাবেই মানসম্মত বই তারা সরবরাহ করতে পারবে না। এটি এনসিটিবি এখন যাচাই-বাছাই করে দেখছে যে, দরপত্রদাতাদের যোগ্যতার কোনো ঘাটতি রয়েছে কি-না। যারা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে, তাদেরই কাজ দেওয়া হচ্ছে- এমনটা এখনো বলা যাবে না। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি’।

তিনি বলেন, ‘আমি যতোদূর জানি, এনসিটিবি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে ভরসা পাচ্ছে না। অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন যেন দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। গত বছর কম রেটে আমরা কাজ করে প্রমাণ করেছি যে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করে দিতে সক্ষম। যদিও কাজের মান নিয়ে একটু প্রশ্ন ছিল। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। আমরা যে মূল্যে টেন্ডার সাবমিট করেছি, তাতে মানসম্মত বই সরবরাহ করতে পারবো’।

শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক দরপত্রের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকরা। কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করে প্রতি বছর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ তুলে দেওয়ায় হতাশ দেশের প্রেস মালিকরা। দেশের বিকাশমান মুদ্রণ শিল্প রক্ষায় প্রেস মালিকরা বিদেশে পাঠ্যবই ছাপার অবসান দাবি করে আসছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর কাছে তারা লিখিত চিঠিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি আশা করছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সরকার সর্বোচ্চ ছাড় দেবে। এতে শুধু প্রেস মালিকরাই নন, হাজার হাজার শ্রমিকসহ দেশের অর্থনীতি আরও সচল হবে বলে মনে করেন তারা।

শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এর আগে একবার কম দামের বই শিক্ষার্থীদের হাতে পড়েছে। আমরা সবাই চাই, ভালো মানের বই যেন শিক্ষার্থীরা পায়। এবার কাকে দিয়ে কি মানের বই ছাপানো হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে এনসিটিবি’র সঙ্গে কথা বলবো। আমাদের দাবি একটাই, কোনোভাবেই যেন নিম্নমানের বই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছে’।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।