ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

জবির হল বেদখল, ঠাঁই মেলে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৬
জবির হল বেদখল, ঠাঁই মেলে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

ঢাকা: কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর ১১ বছরেও রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টি একমাত্র অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই রয়ে গেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের মাথা গোঁজার নেই কোন ঠাঁই।

মেসে থাকাই তাদের একমাত্র নিয়তি। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলা হওয়ার পর অনেক বাড়ির মালিক ব্যাচেলরদের মেস ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন/দিয়ে যাচ্ছেন।   এর ফলে মেস ভাড়া করে থাকার সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, রীতিমতো  যুদ্ধ করে ভর্তি হওয়ার পরও ২০ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনের এই দুরবস্থা রয়েই গেছে । বরং এখন তা আরও প্রকট হয়েছে।

 নিতান্ত বাধ্য হয়েই বেশ কয়েকবার  হলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সমস্যাটির সমাধানের কোনো আগ্রহই নেই প্রশাসন বা সরকারের।

আন্দোলন শুরু হলেই কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে প্রশাসন। তারপর শিক্ষার্থীদের নানা আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করা হয়। পরে আবার হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তারা। আর এখানকার ছাত্রনেতারাও  ছাত্রদের এই অসহায় অবস্থার অবসানের জন্য তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং নিজেদের স্বার্থ বাগিয়ে নেবার ধান্দায় থাকেন।

২০১৩ সালে বেদখল হওয়া হল উদ্ধারের আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর এতে নেতৃত্ব দেয় জবি ছাত্রলীগ। আন্দোলনে আহত হন একাধিক শিক্ষক ও অনেক শিক্ষার্থী।

অভিযোগ আছে, এক পর্যায়ে তিব্বত হলের দখলদার হাজী সেলিমের কাছ থেকে উপরি পাওনা নিয়ে আন্দোলন থেকে সটকে পড়েন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এমনটাই বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ ক’জন শিক্ষার্থী।
 
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কারাগার নাজিমুদ্দিন রোড থেকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হওয়ার পর আবারো হল নির্মাণ ও কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় হল করে তাদের আবাসন সংকট নিরসনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রথম দিকে প্রশাসন কোনো বাধা না দিলেও পরে আন্দোনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। তাদের  অভিযোগ, এই হামলার পেছনে প্রত্যক্ষ মদদ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টর। তবুও আন্দোলনে থেকে সরে আসেননি শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাদের দাবির যথার্থতা স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ ও সরকার লক্ষ্যযোগ্য কিছু না করা পর্যন্ত তারা আর আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না।
 
উল্লেখ্য,  ২০১৩ সালে ও ২০০৯ সালে বেশ কিছু হল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দীর্ঘমেয়াদী ইজারা দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানায় এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি। বেশ কয়েকটি হল উদ্ধার হলেও প্রশাসন কোনো কার্যক্রম হাতে না নেওয়ায় এগুলো আবারও বেদখল হওয়ার পথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি কলেজ থাকাকালে ১২টি আবাসিক হল ছিল। ১৯৮৫ সালের তৎকালীন সরকার বিভিন্ন অযুহাতে সব হল বন্ধ করে দিলে হলগুলো প্রভাবশালী দখলদারদের হাতে চলে যায়।

জবির ১১ টি বেদখল হওয়া হলের বর্তমান চিত্র:

আবদুর রহমান হল :
আরমানিটোলা বটতলার ৬, এসি রায় রোডের  এই হলটিতে বাস করছে পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া ঢাকা আঞ্জুমান সংস্থা হলটি দখলের চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। মূলত এর মালিক ছিলেন চিন্ময়ী দেবী। ১৯৬৫ সালে যা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে জগন্নাথ কলেজকে প্রদান করা হয়। পরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে থাকা শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হলে তারা হলটি ছেড়ে দেন। পরে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যের পরিবারের লোকজন বসবাস শুরু করেন। তবে মূল ফটকে এখনও হলের সাইনবোর্ড রয়েছে। অক্ষত আছে অবকাঠামো।

২. শহীদ আনোয়ার শফিক হল :
আরমানিটোলা মাহুতটুলির ১, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠার হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করে টিন, হার্ডওয়ার ও ফার্নিচারের গোডাউন তৈরি করেছেন তারা। এদের অনেকেই ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিমের আশীর্বাদপুষ্ট বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোডাউনের কর্মচারীরা। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে হলটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন শিক্ষার্থীরা।

৩. তিব্বত হল :
পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯নং জিএল পার্থ লেনের ৮.৮৮৯ কাঠার হলটিও দখলের অভিযোগ রয়েছে সাংসদ হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে হলটির স্থানে স্ত্রীর নামে গুলশান আরা সিটি মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন তিনি। তিনি এই জায়গাটি তার নিজস্ব সম্পত্তি বলে দাবি করেন। ৯০-এর দশকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর স্থানীয়রা হলটির দোতলায় আগুন দিলে তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘তিব্বত হল’ লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও শিক্ষার্থীরা আর হলটিতে ফিরে যেতে পারেননি।

৪. সাইদুর রহমান হল :
 হিন্দুদের দানকৃত এই হল দুটির বর্তমানে কোনো অস্তিত্বই আর নেই। মৌখিকভাবে দান করা সম্পত্তিটি ইব্রাহিম নামের এক আইনজীবী জাল দলিল করে বিক্রি করে দেন বলে জানা যায়। বর্তমানে ১৫, ১৭ ও ২০ যদুনাথ বসাক লেন, টিপু সুলতান রোডের সাইদুর রহমান হলে হার্ডওয়ারের দোকান তৈরি হয়েছে।
 
৫. রউফ মজুমদার হল :
সাইদুর রহমান হলের পাশেই রউফ মজুমদার হল ছিল। জাল দলিলের মাধ্যমে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমানে এখানেও দোকান গড়ে তোলা হয়েছে।
 
৬. শহীদ আজমল হোসেন হল :
পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭নং রমাকান্ত নন্দী লেনের হলটিতে বসবাস করত পুলিশ সদস্যদের পরিবার। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত ‘বেগম রোকেয়া (শহীদ পরিবার)’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জায়গাটি দখল করা হয়। হলটির অবকাঠামো এখনও অক্ষত রয়েছে।
 
 ৭. বজলুর রহমান হল :
 বংশালের ২৬, মালিটোলার হলটিতে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় বানানো হয়েছে। কিছু অংশ স্থানীয় ভূমিদস্যুরা দখল করেছে। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্ররা হলটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
 
৮. বাণী ভবন :
১নং ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনের ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১০ কাঠার বাণী ভবনের কিছু অংশে জবির কয়েকজন কর্মচারী বসবাস করলেও দুই-তৃতীয়াংশ বেদখল হয়ে গেছে। বর্তমানে এখানে ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কয়েকজন কর্মচারী বসবাস করছেন।
 
৯. নজরুল ইসলাম হল :
গোপীমোহন বসাক লেনের ৫/১,২,৩,৪ ও ৬নং টিপু সুলতান রোডে ২০ কাঠা জায়গা নিয়ে হলটি স্থাপিত। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত দখলে ছিল দখলদাররা বর্তমানে এখানে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী নিজ উদ্যোগে সামান্য সংস্কার করে বসবাস করছেন।
 
১০. শহীদ শাহাবুদ্দিন হল :
তাঁতীবাজার ৮২, ঝুলনবাড়ী লেনের হলটি দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন।
 
১১. কর্মচারী আবাস :
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসস্থল ২৬, পাটুয়াটুলীর কর্মচারী আবাসে ছয়তলাবিশিষ্ট ক্রাউন মার্কেট তৈরি হয়েছে। জনৈক ওবায়দুল্লাহ এর মালিকানা দাবি করছেন বলে জানা যায়।

 এখন সরকার ও প্রশাসন যদি আবাসন সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দিকে মুখ তুলে চেয়ে বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধার করে দেয় তাহলে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যাটির সুন্দর সুরাহা হয়। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিত্যক্ত স্থানেও হল নির্মাণ করে দিতে পারে। কিন্তু সরকার কি তা করবে? –এটাই এখন এক বড় জিজ্ঞাসা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১৬
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।