চট্টগ্রাম: উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ১শ ৭৫ বছর পূর্তি উৎসবের সমাপনী দিনে রোববার সন্ধ্যায় জমে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গানে নাচে উন্মাতাল হয়ে ওঠেন গর্বিত প্রাক্তন ছাত্ররা।
শুধু ছাত্ররা নন, বাদ্যের তালে তালে আর সুরের খেয়ায় ভেসে যান উপস্থিত প্রাক্তন ছাত্রদের পরিবারের সদস্য, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাদের মুহুর্মুহু করতালি, দুয়োধ্বনি আর নাচানাচিতে স্মরণীয় হয়ে ওঠে বর্ণাঢ্য উৎসবটি।
কোঁকড়া চুল, রংচটা জিন্স, কালো টিশার্ট, কালো ও মেরুন রঙের ছোট্ট শাল ছিল গানের রাজকুমারের গায়ে। হেলে দুলে হাসিখুশি চেহারা নিয়ে হালকা চালে যখন জনপ্রিয় এ শিল্পী মঞ্চে ওঠেন তখন রোববার রাত পৌনে ১০টা। কিন্তু দর্শকের কমতি নেই। হাজারো দর্শক যেন তারই অপেক্ষায় ছিলেন এতক্ষণ। মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানালেন তাকে।
চট্টগ্রামের দর্শকরা একটু আঞ্চলিক ভাষার আলাপচারিতা বেশ উপভোগ করেন। গানের রাজকুমারের তা যেন অজানা নয়। শুরুতেই বললেন, ‘অনারা ক্যান আছন ওবা? কলেজিয়েট স্কুলর ১শ ৭৫ বছর অইয়ে, ইয়ান কম নঅ ওবা। যারা মরি গেইয়িগই তারার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা। অনারা যারা বাঁচি আছন অনারারে শুভেচ্ছা। কী গান পুনিবারলাই ছঅন হইলে সুবিধা অইব। ’
শুরুতেই কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা ‘সীমান্ত’ দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ের সীমান্তই ছুঁয়ে ফেলেন বিশ্বজিৎ।
আবার কথার পিঠে কথার মালা গাঁথা। বললেন, ‘আঁরার চাঁটগাইয়া ভাষায় আদর গরি নামঅরে বিকৃত গরি ফালায়। য্যান ধরন কি-বোর্ড বাজাদ্দে সুমন কল্যাণ সুমইন্না, গিটারত শ্যামইল্যা, বেজগিটারত বুলবুইল্লা আর ড্রাম বাজারদে বাপ্পিয়া। ’
একটু আয়েশ করে ধরলেন মাইক্রোফোন। বললেন, ‘বেয়াগগুন মিলি জোরে ডাক দিয়ুন। ’ তারপর ধরলেন তার চিরসবুজ গান ‘ও ডাক্তার/আপনি করবেন যখন আমার ওপেন হার্ট সার্জারি/দেখবেন হার্টের মাঝখানে মেয়ে একটা রূপসী ভারি। ’
ততক্ষণে আসর জমে গেছে। গানে বুঁদ শ্রোতারা। তরুণেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠ। কুয়াশা আর নাচের ধুলোর মধ্যে চলছে লড়াই। লড়াই চলছে আলোর মেলা আর সুরের খেলার মধ্যেও।
শিল্পী বললেন, এখানে অনেক নারী আছেন। তাদের জন্য আমার পরের গানটি উৎসর্গ করতে চাই। ধরলেন ‘চতুর্দোলাতে চড়ে দেখো ঐ বধূ যায়’ গানটি।
এবার শ্রোতাদের কাছে তিনি জানতে চাইলেন, ‘বেয়াক কিছু ঠিক আছে না ওবা? এহনতো বউত গানের রিকোয়েস্ট আই গ্যাল। ঠিক আছে, আগে ইবা গাই লই’ বলে মাহফুজের লেখা ও শেখ শাদী খানের সুরে শোনালেন তারই আরেক শ্রোতাপ্রিয় গান- ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে। ’
এবার বললেন, ‘‘আঁই যেত্তে গাইয়ুম নির্বাসনে, অনারা হইবেন ‘যাব না’। ’’ গানের ফাঁকে ফাঁকে গানের কাহিনী, প্রাককথনগুলো উপভোগ করছিলেন দর্শক-শ্রোতা। হাজার হোক শিল্পীর মুখে শিল্পের অজানা কথা। বিরহ যাতনার পর ছেলেদের মনকে প্রবোধ দেওয়ার শক্তি জোগানোর যাদুকরী সেই গানের ছোট্ট ব্যাখ্যা দিয়ে গাইলেন- ‘আমি নির্বাসনে যাবো না’।
পরের গানের আগে আবার গল্প। ‘এ গানটিতে কিছু কথা আছে। আমাদের মেয়েরা ছেলেদের কথায় আসলেই একটু ইমোশনাল হয়। তাই, ছেলেরা যা বলে তাই বিশ্বাস করে। একদিনে পদ্মা-মেঘনা আমার বাপ-দাদাও পাড়ি দিতে পারেননি। তারপরও এ গানটি গাইলে আমার বউ খুশি হয়। মনে করে তাকে নিয়ে গাইছি। ’ বললেন কুমার বিশ্বজিৎ।
এরপর শোনালেন সেই গান, ‘তুমি যদি বলো পদ্মা-মেঘনা একদিনে দিব পাড়ি। ’
পরের গানটা ছিল আশরাফ বাবুর লেখা ও চট্টগ্রামের ছেলে পার্থ বড়–য়ার সুর করা পাশ্চাত্যের সুর সংমিশ্রণে ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে/এখন যে প্রয়োজন তোমাকে/নিঃসঙ্গ এ হৃদয়ে। ’
আচানক পড়ে গেল মাইক্রোফোনসহ স্ট্যান্ড। দৌড়ে এলেন একজন। শিল্পী হাতে নিলেন মাইক্রোফোন। বললেন, এবার ৩ জনই চট্টগ্রামের। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। আবদুল্লাহ আল মামুন, নকীব খান ও কুমার বিশ্বজিৎ। তারপর দর্শক মজে গেলেন ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে হৃদয়ের কোটরে রাখব/আমি নেই নেই। ’
ঘড়ির দিকে তাকালেন রাজকুমার। বললেন, ‘‘১১টায় বাস। মিউজিশিয়ানরা সবাই ঢাকা রওনা হবেন। তাই, এটিই শেষ গান। গাইবো- ‘একতারা’। তার আগে দর্শক-খিদে বুঝেই যেন বললেন, ‘আমাকে একটু আগে উঠতে দিলে ভালো। তাহলে অনেক গান করতে পারতাম। পরে যখন আপনাদের সামনে আসবো, তখন অনেক গান শোনাবো আশা করি। ’’
‘একতারা বাজাইওনা দোতারা বাজাইওনা...একতারা বাজাইলে মনে পড়ে যায় একদিন বাঙালি ছিলাম রে’ এ গানে নিজেকে উজাড় করে দিলেন শিল্পী ও যন্ত্রীদল। গান শেষে শিল্পী জুড়ে দেন, ‘এখনো বাঙালি আছি রে/সারাজীবন বাঙালি থাকবো রে---। ’ সেই সঙ্গে শেষ হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
রোববার সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতে মঞ্চে গানের ডালি নিয়ে আসেন শিল্পী শাহরিয়ার খালেদ ও চৌধুরী মুমু। তারা দ্বৈতকণ্ঠে ‘তুমি যে আমার কবিতা’ ও ‘কিছু আগে হলে ক্ষতি কী ছিল’ গেয়ে আসর জমিয়ে তোলেন।
এরপর ছিল ‘আকাশ এত মেঘলা, যেও নাকো একলা’ ও ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’।
শাহরিয়ার-মুমুর পর মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় শিল্পী অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত। তার দরদী কণ্ঠে বেজে ওঠে- ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ইত্যাদি গান।
অনিরুদ্ধের গানের পর অনুষ্ঠিত হয় বহুল প্রতীক্ষিত র্যাফেল ড্র। ভাগ্যবান প্রাক্তন ছাত্ররা ছিনিয়ে নিলেন পুরস্কার।
‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ দিয়ে শুরু করেন ক্লোজআপ-ওয়ান তারকা কোনাল।
পরের গান ছিল ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা...মনে তো মানে না দিলে তো বোঝে না। ’
এবার মুখ খুললেন কোনাল। শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘চিটাগং আসলে এ গানটি করি। অরজিনাল গেয়েছেন একজন খাঁটি চিটাগাংয়ের শিল্পী। আমি ‘তুই আমারে’ গাইলে আপনারা বলবেন ‘হই’। এটা একটি গেম। আমার প্রিয় গেম। ’’
এরপর তিনি শুরু করেন বিখ্যাত সেই গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা’। নাচতে নাচতে দিওয়ানা হলেন তরুণ শ্রোতারা। শুধু তারুণ্য নয়, জয় করলেন সব বয়সী দর্শকের মন।
এত নাচ! রীতিমতো মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো শ্রোতাদের শান্ত হতে। কোনাল বললেন, ‘আপনারা অবশ্যই নাচবেন, তবে শৃঙ্খলার মধ্যে। ’
আবার গান। কোনালের ছোটবেলায় পড়া কবিতার গান। ‘বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাবুরে/আয় বাবা দেখে যা’।
সাপের নাচের পর দর্শকের চোখে ভাসলো লাউ আর ডুগডুগি। কোনাল গাইলেন, ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম দেখা পাইলাম না’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’।
দর্শকরা চান শিল্পীর গানের সঙ্গে নাচতে। চান হিন্দি গান শুনতে। কোনাল জানালেন, ‘এটা বিজয়ের মাস। দেশের গান দিয়ে শেষ করতে চাই। আপনারা চাইলে বাংলা গানের সঙ্গেও নাচতে পারেন। ’
তিনি শেষ করেন ‘ধানসিঁড়ির মেঠো পথে...সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি/ও আমার বাংলাদেশ প্রিয় জন্মভূমি। ’ কোনালের দরদী কণ্ঠে দর্শকদেরও যেন বাক রুদ্ধ হয়ে এলো। চোখে ভাসে- স্বপ্নস্বদেশ, লাল-সবুজের মেলা।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১১