সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বঙ্গবন্ধু হলের কক্ষ পরিবর্তন নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মী তাহমীদ জামান নাভিদ গ্রুপ ও সাঈদ গ্রুপের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে ওই সংঘর্ষের জেরে নাভিদ গ্রুপ বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে সাঈদ গ্রুপের চারজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে হাসপাতালে পাঠায়।
এরপর ওই হামলার শোধ তুলতে ওইদিন রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের মাষ্টার্সের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহজালালকে ধরে নিয়ে শেরে বাংলা হলের নিচতলার একটি রুমে আটকে নির্যাতন চালায় প্রতিপক্ষ সাঈদ গ্রুপের শান্ত ও তার সহযোগীরা। এদিকে নিচতলার ওই রুমটি হলের প্রভোস্টের রুমের বিপরীত দিকে থাকায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এদিকে পরের দিন বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) উভয় পক্ষের সহপাঠী ও সহযোগীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দেন। তবে সব অভিযোগ ছাপিয়ে নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন ও ক্যাম্পাসের দাবিই জোরালো হয়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে ববির সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠন আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। তবে শুরু থেকেই ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল। তারা ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এর আগে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে ২০১৩ সালে সরকারি জিলা স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে বেশ সমালোচনায় পড়ে ববি শিক্ষার্থীরা।
এরপর নানা কারণে ২০১৭-২০১৮ সালেও প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। বিভিন্ন সংঘর্ষে একসময় লাঠি ব্যবহার হলেও, এখন ব্যবহার হচ্ছে ধারালো বিভিন্ন অস্ত্র।
ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব নিয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে একসময় ছাত্রাবাসে থাকে যেসব শিক্ষার্থী সিসি ক্যামেরা বসাতে আপত্তি জানিয়েছি, নিরাপত্তা কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি এখন তারা উল্টো ছাত্রাবাসে সিসি ক্যামেরা বসানোর দাবি তুলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের এক শিক্ষার্থীর দাবি, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান ও হলে সিসি ক্যামেরা থাকলেও তাদের হলে শুরু থেকেই তা নেই। তাই সম্প্রতি যতো ঝামেলা হয়েছে তার বেশিরভাগই এই হলে। ক্যামেরা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে সেই ভয়ে অনেকেই ঝামেলা করেন না। কিন্তু এখানে এসব বেড়েছে। ছোটখাটো ঝামেলার সূত্র ধরেই হচ্ছে ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার। ফলে নিরাপত্তার স্বার্থে এখন এ হলের শিক্ষার্থীরা সিসি ক্যামেরার দাবি তুলছে।
এ শিক্ষার্থীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ২১ মে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ ব্যাচের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের সাজ্জাদ এইচ হালিমের পেটে পেপসির বোতল ভেঙে ঢুকিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ধারলো অস্ত্রের আঘাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা সিফাত, রফিক ও রুদ্র আহত হন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষ। ওই সময় ছাত্রলীগের কর্মী ফাত্তাউর রাফির মাথায় সরাসরি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। যদিও এসব ঘটনায় আহতরা সবাই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে, কিন্তু আতঙ্ক রয়ে গেছে সারা ক্যাম্পাসে।
অপরদিকে শুরু থেকে এ অব্দি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কোনো কমিটির অনুমোদন দেয়নি কেউ। ছাত্রসংসদ কিংবা ছাত্র কল্যাণ পরিষদও গঠন হয়নি কখনো। কিন্তু স্বঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা কিংবা কর্মী বনেছেন অনেকে। এর মধ্যে কখনও বিএনপি-জামায়াত ঘরানার সদস্যরাও নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। এ নিয়েও সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মাঝে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। সেই দুই গ্রুপই নানান সময়ে নানাভাবে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে।
রুম্মান হোসেন, জান্নাতুল ফেরদৌস, মেহেদী হাসান, জিহান মাহমুদ, ফাহিম হোসেন পিয়াস, জিহাদ রানাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসে দিনে দিনে বাড়ছে লোকালিজম ও ছোট ঘটনায় বড় ধরনের গুজব ছড়ানোর ঘটনা, তাই মারামারি ঘটছে প্রায়ই।
তারা বলেন, শিক্ষার পরিবেশ বজায় রেখে নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি আমাদের। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকেও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সুব্রত কুমার দাস বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি অনাকাঙ্খিত ঘটনাটিকে গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করেই ক্যাম্পাসে ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার আমাদেরও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া ছাত্রাবাসে সিসি ক্যামেরা না থাকার বিষয়টিও অবগত হয়েছি। এসব বিষয় নিয়ে প্রক্টরিয়াল বডির পক্ষ থেকে উপাচার্য মহোদয়কে জানানো হবে। তবে আশা করি সামনে নতুন কোনও দুর্ঘটনার সৃষ্টি হবে না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা বলছেন, দেশে আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থাকার পরও যদি কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বলছে, তারা যে কোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। অপরাধ যেই করুক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২০
এমএস/এইচজে