জাবি: দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দিনগুলো ভালোই কেটেছে ২০১১ সালে। নতুন বিভাগ খোলা, ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে সবুজে ঢাকা বাংলাদেশের একমাত্র এ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ইন্টারনেট ব্যবস্থা উন্নয়নসহ শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য হলগুলোতে ওয়াইফাই সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এই ওয়াইফাই সুবিধা দেওয়ার ফলে হলের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে কিছু কিছু বিভাগে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় সেশন জট আবার শুরু হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে এবং এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সবচেয়ে বড় অর্জন সেশন জট নিরসনের কৃতিত্ব অনেকটা বিলীন হতে শুরু করেছে।
নতুন অনুষদ ও বিভাগ: ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষদ ও তিনটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়। ৬ এপ্রিল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সমম্মেলনে নতুন অনুষদ ও বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
নতুন খোলা অনুষদটি হলো আইন অনুষদ এবং এই অনুষদের অধীনে চালু করা হয় আইন ও বিচার বিভাগ। এছাড়া কলা ও মানবিক অনুষদের অধীনে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ ও জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে চালু করা হয় পাবলিক হেলথ্ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ। চলতি শিক্ষাবর্ষে এই তিনটি বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্মিত হচ্ছে শেখ হাসিনা হল নামে নতুন একটি ছাত্রী হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম খালেদা জিয়া হলের পাশে শেখ হাসিনা হলের নির্মাণ কাজ চলছে। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে এই হলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে সাতশ আসনবিশিষ্ট এ ছাত্রী হলটি নির্মিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবসিক সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়া উচ্চতর গবেষণার দ্বার উন্মোচনে লক্ষ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কারখানার পাশে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা কেন্দ্র ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞান গবেষণার জন্য প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলায়তনের সেমিনার কক্ষে গবেষণার কাজ চলছে। এই গবেষণা কেন্দ্রটি নির্মাণ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণার দ্বার উন্মোচন হবে বলে আশা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু:
রফিকুল ইসলাম রোটন: ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল শনিবার নরসিংদী থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে নরসিংদীর বাঘহাটা এলঅকায় চলনবিল নামক একটি বাস কেড়ে নেয় রফিকুল ইসলাম রোটনের প্রাণ। রোটন ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের ২২৯ নম্বর কক্ষে থাকতেন। রোটনের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার শুবাচর গ্রামে। পিতা চাঁদ আলী সরকার এবং মাতা সালেহা খাতুনের ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
মারজিয়া জান্নাত সুমি : ২০১১ সালের ৯ আগস্ট মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হলে আত্মহত্যা করে মারজিয়া জান্নাত সুমি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হলের ৩১৩ নং কক্ষে থাকতেন এবং ইতিহাস বিভাগের ৩৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ২ আগস্ট তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষা শেষ করে তিনি হলেই অবস্থান করছিলেন। অনার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সুমির গ্রামের বাড়ি জামালপুর। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন।
ভাননেই লিয়ান বম: ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস শুরুর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাননেই লিয়ান বম। সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ৪০১ নম্বর কক্ষে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেলে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ভাননেই লিয়ান বম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার লাইরুন পি গ্রামে।
সাংবাদিক নির্যাতন: ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর বুধবার রাতে ক্যারাম খেলাকে কেন্দ্র করে দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার জাবি প্রতিনিধি মুতাসিম বিল্লাহ নাসিরকে মওলানা ভাসানী হলের ৩২৮ নং রুমে ডেকে নিয়ে মানসিক ও শারিরিক নির্যাতন ও মারধর করে হলের ছাত্রলীগকর্মী রাফসান বিন জামান মিম ও সরকার রাজনীতি বিভাগের নুরুল মুছাব্বির মনির।
এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মওলানা ভাসানী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক খবির উদ্দিনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করে এবং তদন্ত কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেলেও কমিটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়নি।
২০১১ সালের ২২ নভেম্বর দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আহমেদ রিয়াদকে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে খেলাধূলাকে ইস্যু করে মাওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগকর্মী পারভেজ আহমেদের সাথে রিয়াদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে পারভেজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগকর্মীরা দোকানেরে ভেতরে ঢুকে রিয়াদকে মারধর করে এবং দোকান ভাংচুর করে।
পরে ২৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ রফিক-জব্বার হলের শামীম হোসেন, মনিরুল ইসলাম, নাহিদ হোসেন, রাশিদুল হক, মশিউর রহমান ও ইবনে মিজানকে তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে একমাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। নির্বাচনে সভাপতি, সম্পাদক ও দুই জন সদস্য উপাচার্য বিরোধী প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময় : ১২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১১