চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড নানা সঙ্কটে জর্জরিত।
৬৪ শয্যার ৯ নম্বর এ ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে রোগী থাকে ১২০-১২৫ জন।
মেডিক্যাল অফিসার পর্যায়ের ডাক্তার ও ইন্টার্ন ডাক্তার, সেবিকা, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীও অপ্রতুল। শৌচাগারে রয়েছে পানি ও অপরিচ্ছন্নতাজনিত সমস্যা।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সরকারি হাসপাতালে মুমূর্ষু শিশু রোগীদের জন্য আলাদা কোনও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং নবজাতকদের জন্য নিউনেটাল আইসিইউ নেই।
বুধবার দুপুরে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে আসে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শিশু বিভাগের ৩ ইউনিটে ২ জন সহযোগী অধ্যাপক, ১৩ জন সহকারী অধ্যাপক এবং উচ্চশিক্ষার জন্য অবৈতনিক প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক আছেন প্রায় ২৪ জন।
ওয়ার্ড রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা গেছে, বুধবার ভর্তি ছিল ১১৩ জন রোগী। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় ১০ জন, নিউমোনিয়ায় ৪০ জন, সেপটিসেমিয়ায় ১৫ জন এবং বাকি শিশুরা লিউকেমিয়া, ব্রনকিউলাইটিস, অ্যাজমাসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শয্যার তুলনায় বেশি রোগী থাকায় অভিভাবকও ছিলেন বেশি। ফলে শৌচাগারগুলো হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর। সরকারি আয়া নেই, বেসরকারি আয়ারাও সুযোগ বুঝে জরুরি প্রয়োজনে অক্সিজেন, নেবুলাইজার ও এনেমা (ডোজ) দেওয়ার সময় অভিভাবকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ। এক শয্যায় ২ জন শিশু রাখার পরও কয়েকজনকে রাখা হয় মেঝেতে।
এ ওয়ার্ডে সকালের পালায় মাত্র ৩-৪ জন সেবিকা দায়িত্ব পালন করেন। মুমূর্ষু শিশুদের অক্সিজেন, নেবুলাইজার, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা।
অভিভাবকদের সূত্রে জানা গেছে, শিশু ওয়ার্ডে মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিটে কক্সবাজারের ইলিয়াছের ছেলে দেড় মাস বয়সী বাবু সেপটিসেমিয়ায় মারা গেছে।
এর আগের দিন সোমবার ৫টা ২০ মিনিটে কক্সবাজারের রামু উপজেলার আবু তালেবের ছয় বছরের মেয়ে সাহেদা মারা যায়।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট ডা. রিফাত কারনাইন বাংলানিউজকে বলেন, ‘সচরাচর দেখা যায় অভিভাবকরা সব জায়গায় চেষ্টা করে সর্বস্ব হারিয়ে বাচ্চাকে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আনেন। সেপটিসেমিয়াতে ছোট বাচ্চারা বেশি মারা যায়। ’
তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ছোট বাচ্চারা যদি একদম খেতে না চায়, খেলাধুলা বন্ধ করে নেতিয়ে পড়লে বা অজ্ঞান হলে, খিঁচুনি হলে, অনেক দিন জ্বর থাকলে এবং যা-ই খায়, তা-ই বমি করলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
এ সময় তিনি শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ওয়ার্ডের নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে শিশু ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, কম জনবল দিয়েও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছি। গড়ে ১২০জন রোগীর সেবা দিচ্ছেন ৩-৪ জন সেবিকা। পাশাপাশি তাদের দাপ্তরিক অনেক কাজও করতে হয়। প্রতি পালায় ১০ জন সেবিকা দরকার। ঝাড়ুদার আছে প্রতি পালায় একজন মাত্র। সরকারি কোনও আয়া নেই। কিছু বেসরকারি আয়া আছেন। থাকলেও তাদের বেতন নেই। রোগীর অভিভাবকেরা সেবা নিয়ে যে বখশিশ দেন, তা নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
সব সময় এ ওয়ার্ডে রোগীর চাপ থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘৬৪ শয্যার ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন ১২০-১২৫ জন রোগী ভর্তি থাকে। কোনও কোনও সময় তা দুশ’ ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত (ইনফেকশন) রোগী প্রায় ২৫ শতাংশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫০ ভাগই শিশু। গত বছর হাসপাতালের মোট রোগীর ১৫ শতাংশই ছিল শিশু। অথচ শিশু ওয়ার্ডের জন্য বরাদ্দ হয়েছে পুরো হাসপাতালের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ ভাগ। এ কারণে আমাদের নিরুপায় হয়ে মেঝেতে রোগী রাখতে হয়। ’
ডাক্তার সঙ্কট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য, আমাদের এখানে অধ্যাপকের পদ শূন্য দীর্ঘদিন। একজন অধ্যাপক এলে ভালো হতো। মেডিক্যাল অফিসার পর্যায়ের ডাক্তার কম আছে। ইন্টার্ন ডাক্তারদের সুষম বণ্টন নেই। এ বিষয়ে বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। ’
এত কিছুর পরও শিশু বিভাগের বেশ কিছু সাফল্যের কথা তুলে ধরেন ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ‘আমরা সেন্ট্রালি অক্সিজেন সরবরাহ করি শিশুদের। লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে। ডাক্তার-সেবিকা-কর্মচারী সবাই আন্তরিকভাবে সেবা দিচ্ছি। অন্তিম মুহূর্তে শিশুদের ভর্তি করানোর পরও এ ওয়ার্ডের মৃত্যুহার মাত্র ৫ শতাংশ। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১২