ঢাকা: আইন প্রণয়ন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব মুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি মৌলিক অধিকার হিসেবে সকলের জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিত, শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধি এবং শিক্ষানীতি দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে Ôভর্তি বাণিজ্য: জনতার সংলাপÕ শীর্ষক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব দাবি জানান।
গণসাক্ষরতা অভিযানের আয়োজনে এই সংলাপ অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই। সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠান শেষ হয় বেলা ১টায়। বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধyরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান প্রমুখ।
এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বক্তব্য রাখেন।
টিআইবি’র ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনীতি যুক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিবিদরা যেন জড়িত থাকতে না পারেন সে ব্যাপারে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। ’
স্কুলগুলোতে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিরূপণের জন্য ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানান তিনি।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘অন্যান্য ব্যবসার মতো স্কুল প্রতিষ্ঠা বর্তমানে একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। উটকো অর্থনীতি শিক্ষার উপর চেপে বসেছে। ’
রাজধানীর একটি প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য আট কোটি টাকার ভর্তি ফরম বিক্রি করেছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ ভয়ে এসব বিষয়ে অভিযোগ দেয় না। অভিযোগ দেওয়ায় একটি স্কুল থেকে তিন শিক্ষার্থীকে বিদায় নিতে হয়েছে। ’
তিনি প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়নের উপর জোর দেন। এছাড়া শিক্ষাখাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের স্থানীয় সংসদ সদস্যের দায়িত্বে থাকার নজির নেই। ’
তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রভাব মুক্ত রেখে শিক্ষাক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণের আহ্বান জানান।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়োরম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানান ছল-ছুতোয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে। ’
দেশের সকল শিশুকে শিক্ষার আওতায় এনে ঝরে পড়া রোধ ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।
পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভবিষ্যতে ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ করতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে রেখে শিক্ষা আইন করা হচ্ছে বলেও জানান।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাড়তি সেশন ফি’র স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে মান সম্মত করার সুপারিশ করেন।
সংলাপে উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ফি’র নামে ভর্তি বাণিজ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এছাড়াও উন্নয়ন ফি, প্রশংসাপত্র বিতরণ, সেশন ফি, শিক্ষা ভ্রমণসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘যারা শিক্ষার্থী ভর্তির সময় অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে অবশ্যই তা ফেরত দিতে হবে অথবা ভবিষত বেতনের সঙ্গে তা সমন্বয় করতে হবে। এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। অভিযোগ যাচাই করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
তিনি বলেন, মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। শিক্ষার মান বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে এবং তা অনেক দূর এগিয়েছে। ’
শিক্ষাখাতের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, সরকার ও নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে বলেও মনে করেন মন্ত্রী।
সংলাপে মণিপুর স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য ও উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং সাংবাদিক লাঞ্ছনার বিষয়টি উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে অভিভাবকদের মধ্যে নাটোরের সৈয়দ তাজ, মণিপুর স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক এবং টেলিফোনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকজন অভিভাবক অংশ নিয়ে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। যারা ভর্তি বাণিজ্য করছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তারা।
অতিরিক্ত ফিয়ের জন্য ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি বলে জানান ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ নাহিদ, খুলনার সবুর নেসা গার্লস স্কুলের নিমা আক্তার লিজা। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১২