বাগেরহাট: এসএসসি পাস করার পর অনেক স্বপ্ন নিয়ে ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (আইএমটি), বাগেরহাটে ভর্তি হয়েছিলাম। শিক্ষা জীবনে শিপবিল্ডিং টেকনোলজির খুঁটিনাটিসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক বিষয় শিখেছি।
এভাবেই হতাশা প্রকাশ করছিলেন ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি, বাগেরহাটের শিপবিল্ডিং টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. অমিত হাসান।
শুধু অমিত হাসান নন, এ প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বক্তব্য একই রকম। কারণ মেরিন টেকনোলজি ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজিতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রিসহ উচ্চশিক্ষার তেমন সুযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) পরিচালিত ছয়টি সরকারি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি রয়েছে দেশে। এসব প্রতিষ্ঠানে মেরিন টেকনোলজি ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা পড়ানো হয়। প্রতিবছর সরকারি এ ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে দুই ট্রেডে প্রায় সাড়ে সাতশ’ শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এর বাইরে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মেরিন টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেন। এ শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির সুযোগও নেই বললেই চলে। সরকারি চাকরির বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়ানো ডিপ্লোমা ট্রেডের নাম থাকলেও মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজির নাম থাকে না। যার ফলে সরকারি চাকরি পাওয়া তো দূরের কথা, চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণেরও সুযোগ থাকে না এই দুই ট্রেডে ডিপ্লোমাধারীদের। অথচ দেশের বিভিন্ন আইএমটিতে পড়ানো মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজি ট্রেডের কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানের। ভর্তিও হন মেধাবীরা।
অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রম করে চার বছরের ডিপ্লোমা শেষ করে নিজ ট্রেডে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নও অধরা রয়ে যায় মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজি শিক্ষার্থীদের। কারণ বাংলাদেশে মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজিতে বিএসসি শিক্ষাক্রম চালু নেই। এ দুই ট্রেডের শিক্ষার্থীদের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। সেখানে সিট মাত্র ১২০টি। এতো কম সিটের বিপরীতে মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজির হাজার খানেক শিক্ষার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় পলিটেকনিক থেকে পাশ করা আরও কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে। বাস্তবিক পক্ষে ১২০টি সিটের বিপরীতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া খুবই কঠিন। যার ফলে বাধ্য হয়ে উচ্চশিক্ষার আশা ছেড়ে দেন মেরিন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
আইএমটি, বাগেরহাটের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী মো. ফাহিম বলেন, এসএসসিতে একটা ভালো ফলাফল করে মেরিন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই আমরা। কিন্তু লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরিও পাই না, আবার বিএসসি করারও সুযোগ নেই।
শারমিন আক্তার সজনী নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় আমরা মেরিন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু লেখাপড়া শেষে হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না।
হুমায়ুন কবির, নাজমুল ইসলামসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, শুধু যে উচ্চশিক্ষার দ্বার বন্ধ তা নয়, আমাদের বিদেশি জাহাজে চাকরি করার স্বপ্নও বন্ধ করে রেখেছে একটি কুচক্রি মহল। বিদেশি জাহাজে চাকরি করতে হলে সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) নামে একটি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন নানা তালবাহানা করে ২০১০ সাল থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে পরিচালিত ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সিডিসি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধুমাত্র সিডিসির অভাবে তারা বিদেশি জাহাজে চাকরি করতে পারেন না।
তাইফুর রহমান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা সব দিক থেকে যোগ্য ও মেধাবী। কিন্তু তাদের নানাভাবে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, অতিদ্রুত সরকারি চাকরিতে যেন মেরিন এবং শিপবিল্ডিং টেকনোলজিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন ও শিপবিল্ডিং বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং চালু করে আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে বিদেশি জাহাজে চাকরির জন্য সিডিসি দেওয়ার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন শিক্ষার্থীরা।
জাহিদ রায়হান বলেন, প্রধানমন্ত্রী এক সময় বলেছিলেন, মেরিন ও শিপবিল্ডিং শিক্ষার্থীদের জন্য নৌ-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর এ ওয়াদা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। অতিদ্রুত উচ্চশিক্ষার এ সংকট নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এ শিক্ষার্থী।
খুলনা শিপইয়ার্ডের সহকারী প্রকৌশলী (শিপবিল্ডিং) এমএ সালাম বলেন, মেরিন এবং শিপবিল্ডিং সেক্টরে দক্ষ জনশক্তির অনেক অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন শিক্ষার এ দু’টি ক্ষেত্র দেশের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় মেরিন এবং শিপবিল্ডিং ট্রেডে ডিপ্লোমাধারীদের এ ট্রেডে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে বিএসসি করার সুযোগ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকছেন। আবার তাদের প্রডাক্টিভিটি বাড়ছে না। একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার যদি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে তিনি তার কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি কাজ করতে পারতেন। এ সেক্টরের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতেন। অনেকে আবার ডিপ্লোমা শেষে দেশের টাকা ব্যয় করে বিদেশে মেরিন ও শিপবিল্ডিংয়ে বিএসসি করে আসছেন। কিন্তু দেশে সুযোগ পেলে, তারা কখনও বিদেশে যেতেন না।
তিনি আরও বলেন, জাহাজের ইঞ্জিন ও মেশিনারিজ সম্পর্কে আইএমটির শিক্ষার্থীদের মতো ভাল ধারণা খুব কম প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটদের রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র বিএসসি করতে না পাড়ায় তারা পিছিয়ে থাকছেন। এমনকি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনেও ভালো পদে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। বিএসসি করতে না পাড়ায় বিসিএস পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারছেন না। অথচ অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করে ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে পড়েন। জাহাজ শিল্পের উন্নয়নে এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রডাক্টিভিটি বৃদ্ধিতে এ দুই ট্রেডে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম চালুর দাবি জানান এ প্রকৌশলী।
অন্যদিকে দেশের সরকারি বেসরকারি শতাধিক পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা শেষ করা শিক্ষার্থীদেরও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান একমাত্র ডুয়েট। এক্ষেত্রেও সামান্য কিছু ট্রেডের বিপরীতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। যার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে না।
ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি, বাগেরহাটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. শামিম হোসেন বলেন, আমাদের এখানে সাধারণত মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন। চার বছরে আন্তর্জাতিক মানের একটি শিক্ষাক্রম শেষ করে তারা দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু এখান থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুব কম। আমাদের এখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়নি। এখানের শিক্ষার্থীদের যদি পলিটেকনিক ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের মতো বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ থাকত, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের জন্য আরও সম্পদ হতো।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, চার বছরে আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে জাহাজের ইঞ্জিন, জাহাজ নির্মাণসহ জাহাজ শিল্প সংক্রান্ত নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকি। কিন্তু বিএসসি পড়ার সুযোগ না থাকায় এসব দক্ষ শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না। ব্লু ইকোনমিকে আরও বেশি সচল ও বেগবান করার জন্য এ সেক্টরে উচ্চশিক্ষা চালু করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, শুধু মেরিন এবং শিপবিল্ডিং ট্রেড নয় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পড়ানো বিভিন্ন ডিপ্লোমা ট্রেডে সরাসরি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ নেই আমাদের দেশে। কারিগরি সেক্টরে দক্ষ কর্মী গড়ার উদ্দেশে সরকার ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রম চালু করেছিল। কিন্তু ডিপ্লোমা পাসের পর উচ্চশিক্ষার জন্য যে পাথওয়ে থাকা প্রয়োজন, সেটা বাংলাদেশে খুব একটা নেই। সরকারিভাবে একমাত্র ঢাকা প্রকৌশল ও ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায়। সেখানে তো আসন এবং সুযোগ দুটিই সীমিত, তাহলে এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যাবেন কোথায়। শুধু পদ্ধতিগত কারণে এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ড. এসএম হাফিজুর রহমান আরও বলেন, কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ৪০টির মত ট্রেডে ডিপ্লোমা বিষয় চালু রয়েছে। এর মধ্যে সবাই বিএসসি করতে চান না। কিন্তু যারা চান, তাদের জন্য তো আমাদের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি ম্যাপিং করতে হবে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকা এবং না থাকার বিষয়গুলো আলাদা করতে হবে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা নেই, সেখানে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি সরকার এখনই এ ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি পাথওয়ের মাধ্যমে এসব কোর্স চালু করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের প্রণোদনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডে বিএসসি চালু করতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, কারিগরি শিক্ষা সেক্টরে সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করছে। ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যার সমাধানও হবে আশা করা যায়।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ) মীর খায়রুল আলম বলেন, মেরিন ও শিপবিল্ডিং শিক্ষার্থীদের বিদেশি জাহাজে চাকরির জন্য সিডিসি দেওয়া নিয়ে একটি সমস্যা রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আশা করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিডিসির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেরিন ও শিপবিল্ডিং টেকনোলজিতে ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের যদি উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিএসসি, এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার আগ্রহ থাকে, তাহলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২২
এসআই