ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

এমপি বাদশাকে ইঙ্গিত করে রাবি প্রশাসনের প্রতিবাদ

রাজশাহী করেসপন্ডেন্ট, (রাবি) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২২
এমপি বাদশাকে ইঙ্গিত করে রাবি প্রশাসনের প্রতিবাদ

রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় এবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী-২ সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাকে ইঙ্গিত করে তার মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শাহরিয়ারের মৃত্যুর দিনের ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।

বুধবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে জারিকৃত বিবৃতিতে শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় তৈরি হওয়া উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে এমপি বাদশাকে ইঙ্গিত করে বলা হয়. তার বক্তব্য কাণ্ডজ্ঞানহীন ও পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে উস্কানিমূলক।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজশাহীর একজন জনপ্রতিনিধি (সরাসরি নাম প্রকাশ না করে, সংসদ সদস্য বাদশাকে ইঙ্গিত) শিক্ষার্থী শাহরিয়ারকে হত্যা করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও তার পরিবারকে হুমকি দিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে পালিয়ে যাওয়াসহ হাসপাতালে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে গণমাধ্যমে অমূলক তথ্য প্রদান করেছেন। তিনি অনাকাঙ্খিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ষড়যন্ত্রকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে জনপ্রতিনিধির বাস্তবজ্ঞানহীন ও উস্কানিমূলক বক্তব্য কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ও সামগ্রিকভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও রাজশাহী শহরে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমন বক্তব্য কোনো দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে আশা করা যায় না। তার বক্তব্য পরিস্থিতি শান্ত করার চেয়ে তা আরও জটিল করেছে। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে ও ঘটনার খণ্ডিত অংশকে ব্যবহার করে তিনি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষানগরী রাজশাহী ও সমগ্র দেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে বিব্রত করেছেন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্ট পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে তিনি পরিস্থিতি উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারতেন, এমন কোনো উদ্যোগ তার পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যায়নি।

জন প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, তার বক্তব্য অনুসারে শাহরিয়ার যদি আগই মারা গিয়ে থাকে, তবে তার মরদেহ জরুরি বিভাগ থেকে মর্গে না রেখে চিকিৎসার জন্য ৮ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠানো হলো কেন? তার শরীরে কেন স্যালাইন পুশ করার ও অক্সিজেন দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো? শাহরিয়ারের লাশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তার পরিবারের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। মৃতের বড় ভাই কোনো ধরণের অভিযোগ বা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রহণ করেন। ডাক্তাররা যদি এতটাই নিশ্চিত থাকেন, শাহরিয়ারকে আগেই হত্যা করা হয়েছে, তবে হত্যা ও আগের রাতের ঘটনাবলীর কথা বিবেচনা করে কেন বিনা ময়নাতদন্তে লাশ হস্তান্তর করলেন? লাশ হস্তান্তরের দায়দায়িত্ব ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের।

নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একক মালিক হিসেবে দাবী করে রাজশাহীর সেই জনপ্রতিনিধি শুধু নিজেকেই হেয় করেননি বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাস করেন এমন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শিক্ষার্থীদের সবাইকে মর্মাহত ও অপমানিত করেছেন। যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশের ক্রান্তিকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ভূমিকা পালনের গৌরবময় অতীতের বিষয়টি তিনি একেবারেই ভুলেই গেছেন। এমনকি জোহা স্যার ও স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের রক্তস্নাত মতিহার ক্যাম্পাসকে তিনি হেয় প্রতিপন্ন করেছেন।

বিবৃতিতে শাহরিয়ারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ও উভয়পক্ষের মামলার বিষয়েও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গত ১৯ অক্টোবর শহীদ হবিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হলের তৃতীয় তলা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হলে তাৎক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সযোগে চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। শাহরিয়ারকে সেসময় আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে যথাযথ চিকিৎসা না দিয়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠান। ওই ওয়ার্ডে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডাকাডাকির প্রায় আধা ঘণ্টা পর চিকিৎসক ও নার্স আহত শাহরিয়ারের কাছে আসেন। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না দিয়ে চিকিৎসক ও নার্স নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা শাহরিয়ারকে মৃত ঘোষণা করেন।

শাহরিয়ারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হতবিহ্বল সহপাঠী ও বন্ধুরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছায় এবং কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে থাকে। সেই সময় ৮ নম্বর ও তার আশপাশের ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্স, ব্রাদার, আনসার ও তাদের উচ্ছৃঙ্খল সহযোগীরা ন্যাক্কারজনকভাবে শোকার্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এসময় লাঠি এবং শল্যচিকিৎসায় ব্যবহৃত ধারালো যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা আনুমানিক শতাধিক শিক্ষার্থীকে হাতে, পিঠে, মাথায় আঘাত করে গুরুতর আহত করে। আহত শিক্ষার্থীদের অনেককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্র, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ রাজশাহীর অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা এবং মার্কেটিং বিভাগের সভাপতিসহ ওই বিভাগের শিক্ষকদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাসপাতালের কতিপয় ব্যক্তির অসহিষ্ণু ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ যাতে তৈরি না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত শাহরিয়ারের মৃত্যু এবং হাসপাতালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করে। এমনকি মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর পরই সেই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মতিহার থানায় একটি অভিযোগ করে যা পরবর্তীতে অপমৃত্যুর মামলা হিসাবে থানা গ্রহণ করে। সঠিক ঘটনা উদঘাটন ও পরিস্থিতি উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের কোনো ঘাটতি ছিল না।

ঘটনার দিন রাতে পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যৌথ বৈঠকে ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বৈঠকে গঠিত কমিটির সভা আহ্বানের আগেই পরবর্তী দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করে। একদিকে চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিৎসক এবং নার্সসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হওয়া, ঘটনার দিনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করায় পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাহরিয়ারের মৃত্যু ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ন্যায়বিচার চেয়ে রাজপাড়া থানায় অভিযোগপত্র জমা দেয়।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চিকিৎসাপ্রার্থী অসহায় মানুষদের প্রতি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক, ইন্টার্ন, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এমনকি বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর হামলা-মারধরের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে সেগুলো প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। একজন চিকিৎসাপ্রার্থীর সাথে কোনো চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের অসংগত আচরণ কখনোই কাম্য নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়।

উভয়পক্ষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৌহাদ্যপূর্ণ নিরসন করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় বিবৃতিতে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।