পাবনা: পাবনা সদরের পদ্মা নদীর তীরবর্তী চরে অবস্থিত ২৯-নং চর মাছপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত। এ বিদ্যালয়ের (স্কুল) নিয়োগপ্রাপ্ত তিনজন শিক্ষকই শহরে থাকেন।
তাদের ঠিক করা স্থানীয় তিনজন প্রক্সি দেন। এ তিন প্যারা শিক্ষক (চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক) দিয়ে চলছে স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক স্কুলে না যাওয়ায় প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বাড়িতে বসে সরকারের সব সুযোগ সুবিধা নিলেও নিয়মিত স্কুলে না যাওয়ার কারণে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে।
পাবনা সদরের ভাঁড়ারা উইনিয়নের শেষ প্রান্ত পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী চর এলাকায় অবস্থিত চর মাছপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পদ্মা নদীর তীরবর্তী চর ভানাপুর মৌজার তিনটি গ্রামের জমিতে এ স্কুলের অবস্থান। ১৯৫৮ সালে স্থাপিত এ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কক্ষ সংকটের কারণে ২০১২ সালে নতুনভাবে নির্মাণা করা হয় ছয় কক্ষের দোতলা পাকা ভবন। প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য তৈরি করা এ স্কুলে সহকারী শিক্ষকসহ নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র তিনজন শিক্ষক। ওই তিন শিক্ষকের প্রত্যেকের বাড়ি পাবনা শহরে হওয়ায় তারা নিয়মিত স্কুলে যান না। স্থানীয় তিনজন ভাড়াটিয়া শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন বলে আভিযোগ স্থানীয়দের।
প্যারা শিক্ষক নিয়োগের পর থেকে সপ্তাহে বা মাসে একদিন করে পালাক্রমে স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আসেন তারা।
সম্প্রতি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাস রুমে পাঠ দান করছেন তিনজন শিক্ষক। ক্লাসে তেমন শিক্ষার্থী নেই। মাঠে কিছু শিক্ষার্থী খেলাধুলা করছে। যারা ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এ স্কুলের প্যারা শিক্ষক। স্কুলের নিয়োগকৃত শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসতে পারেন না বলে তারা ক্লাস নিচ্ছেন। আর তারাই স্কুল খুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। আর এর বিনিময়ে তারা মাসে সামান্য সম্মানি পেয়ে থাকেন শিক্ষকদের কাছ থেকে।
নিয়োগকৃত তিন শিক্ষকের একজন মো. ফারুক হোসেন। তিনি সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করেন। অপর দুই শিক্ষক হলেন- মো. রেজাউল করিম ও মো. সেলিম রেজা। তাদের কাউকে স্কুলে পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীরাও স্কুলের প্রকৃত শিক্ষকদের নাম পরিচয় ভালোভাবে বলতে পারেনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. রবিউল ইসলাম ও আসাদুল মোল্লা বলেন, বহুবার বলা হয়েছে শিক্ষকদের, তারা নিজেদের মতো করে স্কুল চালাচ্ছেন। চর অঞ্চল বলে এখানে দেখার কেউ নেই। আমাদের শিশুরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের বললে, তারা আমাদের কথা শোনে না। ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া করানো হচ্ছে। কী শিক্ষা পাচ্ছে ওরা, একবার ভাবেন। বহুদিন আগে শহর থেকে অফিসাররা একবার এসেছিলেন, তারপর আর খোঁজ নাই তাদের।
সোহেল মোল্লাসহ কয়েকজন অভিভাবক বলেন, আগে আমাদের বাচ্চাদের নদী পার হয়ে আরেক চরের স্কুলে যেতে হতো। এখন আমাদের চরেই স্কুল হওয়ায় সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এ স্কুলের শিক্ষকদের এলাকার মানুষ আর বাচ্চারাই ভালোভাবে চেনে না। মাঝে মধ্যে আসেন, কিছু সময় থাকেন, আবার চলে যান। আমরা কাজে থাকি, এতো দেখে রাখার সময় কোথায়। সরকার আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য স্কুল দিয়েছে, শিক্ষক দিয়েছে। কিন্তু তারা ফাঁকি দিচ্ছেন। প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালাচ্ছেন। ভাড়াটে শিক্ষকরাও আবার দেরি করে স্কুলে আসেন, একটা-দুইটা ক্লাস নিয়ে চলে যান। বেশির ভাগ সময় স্কুল বন্ধ থাকে। বিভিন্ন দিবসে আসল স্যারদের দেখা যায়। এছাড়া তারা শহরেই থাকেন।
প্যারা শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ স্কুলে সরকারের নিয়োগকৃত তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। দুর্গম চর হওয়ায় শহর থেকে যাতায়াত অনেক কষ্টকর। তাই তারা নিয়মিত আসতে পারেন না। আমি ছাড়াও তাসলিমা খাতুন ও মনিরা খাতুন নামে আরও দু’জন তাদের হয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা নিয়মিত স্কুলে এসে বাচ্চাদের ক্লাস নিয়ে থাকি। বিনিময়ে তারা আমাদের আর্থিক সম্মানী দিয়ে থাকেন। সপ্তাহে একদিন করে পালাক্রমে তারা স্কুলে অসেন। আমরা টাকা পাই, ক্লাস নেই।
এ তিনজনের মধ্যে রফিকুলসহ দু’জন মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা পান। আর অপর জন পান তিন হাজার করে।
স্কুলের শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন বলেন, দুর্গম চরে যাতায়াত অনেক কষ্টকর। পদ্মা নদী পার হয়ে তবু আমরা চেষ্টা করি নিয়মিত গিয়ে ক্লাস নেওয়ার। মাঝে মধ্যে সমস্যার কারণে যাওয়া হয় না। এ স্কুলে মো. রেজাউল করিম ও মো. সেলিম রেজা নামে নিয়োগপ্রাপ্ত আরও দু’জন শিক্ষক রয়েছেন। আমরা তিনজন পরামর্শ করে স্কুল সুন্দরভাবে চালিয়ে আসছি। প্যারা শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে বলেন, আসলে স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য স্থানীয় তিনজনকে সহযোগী হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে যারা অভিযোগ দিয়েছেন, তারা নিছক না বুঝে অভিযোগ দিয়েছেন। আপনারা তো সেখানে গেছেন। একজন মানুষের যাতায়াত করতে অনেক টাকা খরচ হয়। সেখানে থাকার মতো পরিবেশ নেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদার বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক, নিয়োগকৃত শিক্ষকরা শহরের বাড়িতে বসে প্যারা শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালাবেন এ রকম কোনো সুযোগ নেই। অবশ্যই সেখানে গিয়ে নিয়মিত স্কুলের কার্যক্রম ও ক্লাস নিতে হবে তাদের। যদি এ ঘটনা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি যাতায়াত কষ্টকর হয়, তাহলে সেখানে থেকে ক্লাস নিতে হবে। প্যারা শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর তীরবর্তী চর মাছপাড়া স্কুলের অবস্থান। সদরের ভাঁড়া ইউনিয়নের শেষ প্রান্ত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত এ স্কুল। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঘরে বসে বেতন তুলছেন এক শ্রেণির শিক্ষক।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২২
এসআই