ঢাকা: পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল বা উস্কানিমূলক উদ্দীপক নতুন নয়। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় ভুল হওয়া কিংবা উস্কানিমূলক প্রশ্নের নজির আছে এবং তা নিয়ে নানা সমালোচনা দেখা দেয়।
সবশেষ চলতি এইচএসসি পরীক্ষার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষায় ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগ ওঠে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলছেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-১ নতুন ও পুরাতন সিলেবাসের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ভুলের কারণে তা স্থগিত করা হয়, যা ত্রুটি বলে স্বীকার করেন মন্ত্রী।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনার সামাজিক প্রভাব পড়বে। সাম্প্রদায়িক অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার মতো। শিক্ষার্থীদের ভেতর এ বিষয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে সেটা তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে কিনা এটি একটি বড় চিন্তায় বিষয়। এছাড়া এ ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিলক্ষিত হয়। মোটকথা, সামাজিক পরিবেশে এ ধরনের বিষয় দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতে ইতিবাচক নাড়া দেওয়া কঠিন।
আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার ঢাকা বোর্ডের ১১ নম্বর প্রশ্নপত্রে এমন ত্রুটির বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষায় একটি প্রশ্নে সনাতন ধর্মালম্বী এবং মুসলমান ধর্মের মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদের উদ্দীপক তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে প্রশ্নে মীর জাফরের চরিত্র দিয়ে আরও বিভাজন হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশ্নপত্রের এই অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। সমালোচকরা বলছেন, এটি কি উদ্দেশ্যমূলক না ভুল তা যেন ভালোভাবেই তদন্ত করে বের করা হয়। এবং ভবিষ্যতে যাতে এরকম না হয় সেটিও দেখতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সেই প্রশ্ন নিয়ে আর কী বলার আছে পুরো সমাজকে সাম্প্রদায়িক করা হয়েছে। আমাদের জীবদ্দশায় এমন দেখব, এটা ভাবা যায়!
শিক্ষামন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এই প্রতিক্রিয়া ভালো, নীতি নির্ধারকের কাছে এটা প্রত্যাশিত। আশা করবো, যেভাবে বলেছেন সেভাবে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এগুলো কী আরও ঘটতে থাকবে- প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায় এবং দায়িত্ব নিতে হবে।
কেন ভুল বা উস্কানি
প্রশ্নপত্রে উস্কানি থাকার বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া থাকে যে কী কী বিষয় মাথায় রেখে প্রশ্নগুলো তারা করবেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার কোনো কিছু যেন না থাকে সেটিও নির্দেশিকায় আছে।
তিনি বলেন, খুবই দুঃখজনক যে কোনো একজন প্রশ্নকর্তা হয়তো এ প্রশ্নটি করেছেন এবং যিনি মডারেট করেছেন তার দৃষ্টিও হয়তো কোনো কারণে এড়িয়ে গেছে বা তিনিও হয়তো এটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। আমরা চিহ্নিত করছি এই প্রশ্নটি কোন ‘সেটার’ করেছেন বা কোন ‘মডারেটর’ করেছেন, আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বাংলানিউজকে বলেন, প্রশ্ন ‘সেটার’ এবং ‘মডারেটরের’ ভুলের কারণে এমনটা হতে পারে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপর একটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বাংলানিউজকে বলেন, যে উস্কানিমূলক বিষয়টি এসেছে এটার জন্য ঢাকা বোর্ডকে এখনই দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ এটা অন্য কোনো এক বোর্ডের প্রশ্ন। প্রশ্নের বিভিন্ন বোর্ডের সেট থেকে একটি সেট নিয়ে ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষা হয়েছে। ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্রের মূল পান্ডুলিপি বের করলে জানা যাবে এটি কোন বোর্ডের প্রশ্ন এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত।
ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নে ধর্মীয় উস্কানির বিষয়টি থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা কুমিল্লা বোর্ডের বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. জামাল নাছের বাংলানিউজকে বলেন, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এরপর সেটি মিলিয়ে দেখা হয়, কিন্তু তা অমিল পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরির নির্দেশিকায় বলে দেওয়া থাকে রাষ্ট্র, সমাজ বা ধর্ম বিরোধী বা প্রথিতযশা ব্যক্তিদের নিয়ে প্রশ্নপত্রে কিছু লেখা যাবে না। এরপরও কেন হলো সেটা ভুলে না উদ্দেশ্যমূলক তা তদন্ত করলেই জানা যাবে।
শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব পড়বে কিনা
এ বিষয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সোজা কথায় বলতে গেলে এটার মধ্য দিয়ে আমাদের সবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে। এমন একটা প্রজন্মকে টার্গেট করা হচ্ছে, যেখানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত, যারা সহজে গিলতে পারবে। যাতে তাদের মনকে বিষিয়ে তোলা যায়। এমন ভুল হওয়ার কথা না। এমন একটা ভাবমূর্তি দেওয়া হচ্ছে যেখানে নবাব সিরাজ উদ দৌলা আমাদের বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেখানে মীর জাফরকেও টেনে আনা হয়েছে।
প্রশ্নপত্রে ভুল কিংবা উস্কানি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের ধর্মীয় উস্কানিমূলক কথা-বার্তা শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক প্রভাব পড়ে। যেভাবে ধর্মীয় উস্কানি দেওয়া হয়েছে তার মধ্য দিয়ে তো জঙ্গি তৈরি হবে।
‘প্রশ্নপত্রে এমন ভুল বা উস্কানি মেনে নেওয়া যায় না। বার বার এমন হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, এই প্রশ্নটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে৷ আমি এটা দেখে খুবই সংক্ষুব্ধ হয়েছি৷ সংশ্লিষ্ট ধর্মের অনুসারীরাও সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে এটি খুব পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে৷ সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। আর এটা কোনো সঠিক সৃজনশীলতা হতে পারে না। আমি মনে করি এখানে শিক্ষকদের বড় একটি দায়িত্ব রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোললজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বলেন, এ ধরনের প্রশ্নের ফলে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে অবচেতনভাবেই দাগ কাটে। যদি দাগ কাটতে হয় তাহলে নেগেটিভিটি ছড়িয়ে নয়, পজিটিভিটি ছড়িয়ে হোক৷ কৈশোর বয়স খুবই যত্নের সঙ্গে অতিক্রম করতে হয়, তাদের অনেক মানসিক চাপ থাকে, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফারাক থাকে সেসময়ে এরকম প্রশ্ন তৈরি করা বিপজ্জনক।
তিনি আরো বলেন, দু-একজন শিক্ষকের এরকম প্রশ্ন তৈরি করার কারণে পুরো শিক্ষক সমাজ সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। তাদের (শিক্ষক) মনোজগতের পরিবর্তন দরকার।
মডারেশন করে প্রশ্ন তৈরি, প্রশ্ন তৈরি কমিটি থাকার পরেও কীভাবে এ প্রশ্ন তৈরি হলো প্রশ্ন রেখে মেহজাবীন হক বলেন, তাহলে আমাদের ঘাটতিটা কোথায়! সেটা খুঁজে বের করতে হবে। একজন শিক্ষক শুধু নিজের একটি বিষয়ে দক্ষ হবেন, এমন নয়। তাকে শিক্ষার্থীদের মনও বুঝতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাইন্ড বুঝতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দরকার বলেও মনে করেন অধ্যাপক মেহজাবীন হক।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২২
এমআইএইচ/এসআইএস