শুন্যে হেলান দিয়ে চেয়ার দু’টো এখনও চেয়ে আছে সাগরপানে। পায়ের নিচে চুমু দেওয়া ঘাস, আশপাশে অবহেলায় বাড়ন্ত লতা-গুল্ম, ভাঙা গেট আগলে রাখা কলাগাছটা বৃষ্টি পেয়ে সজীব আরও।
২০ জুলাইয়ের বিকেল পর্যন্ত দৃশ্যপট একই আছে। বদলায়নি এতোটুকু। শুধু যে মানুষটা ক্যামেরা খুলে শিকারী চোখ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ছবিটির নাম দিয়েছিলেন ‘দু’টো চেয়ার ও একটি বিকেল ছিলো কারও অপেক্ষায়’; তিনি নেই। উঠে গেছেন।
কেউ কেউ তাকে দেখেছে সৈকতজুড়ে হেঁটে যেতে। লম্বা পা ফেলে বিষণ্ন দুপুরে তার উজ্জ্বল দৃষ্টিও দেখে ফেলেছে কেউ। দেখেছে সমুদ্রে নামতে। আর যে ক’জনের চোখে-মুখে-বুকে এখনও ছোপ ছোপ আতঙ্ক, আশংকা, উদ্বেগ; তাদের অভিজ্ঞতায় আছে ভয়াবহ দৃশ্য। উত্তাল সমুদ্র তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে মিশে যাচ্ছেন তিনি, হারিয়ে যাচ্ছেন...
চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। একটা দিন-রাত। এখনও ফারুক হোসেনকে পাওয়া যায়নি। তার ফেসবুকের দেয়াল ভরে গেছে ভক্ত, বন্ধু, প্রিয়জন, সহকর্মীদের বেদনায়। প্রত্যেকেই লিখছেন, ‘ফিরে আসুন। ’ এই শব্দ দু’টো লিখতে যে কি পরিমাণ বেদনা খরচ হচ্ছে, যেটা ফারুক হোসেনকে যারা চেনেন, তারা জানেন। একেকটি পোস্ট যেন একেকটি শোকের পোস্টার!
ফারুক হোসেন গল্প আর চিত্রনাট্য লিখতেন। ক্যামেরার পেছনে নির্দেশনাও দিয়েছেন টুকটাক। তবে তার লেখনীর শক্তি ছিলো লক্ষণীয়। শুধু নাটক লিখে, এই সময়ে, এতো মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়; সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন সবাই ১৯ জুলাইয়ের বিকেল থেকে। ঈদের ছুটি কাটাতে কক্সবাজার ছুটে গিয়েছিলেন ফারুক। বৈরী আবহাওয়া। উত্তাল ঢেউ। কড়া সতর্কবার্তা। এর মধ্যেও তিনি নেমে পড়েছিলেন সমুদ্রে। তারপর কেটেছে চব্বিশ ঘণ্টা। সেই যে তিনি ডুব দিলেন। ফেরেননি এখনও।
সমুদ্র ছিলো ফারুকের প্রিয়। সালাহউদ্দিন লাভলুর ‘ওয়ারিশ’ ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে গানও লিখেছিলেন ফারুক- ‘চলো হাত ধরে মরে যাই/চলো যাই সাগরে/অনেক গভীরে/তারপর ইচ্ছে করে ডুবে যাই। ’ রেকর্ডিংয়ের সময় সামিনা চৌধুরী তাকে বলেছিলেন, ‘এই ছেলে! এমন গান কেন লিখেছো? পাগল ছেলে!’ এই ‘পাগল ছেলে’ যে গানের মতো সত্যিই সমুদ্রে চলে যাবে, ডুবে যাবে ‘ইচ্ছে করে’; সামিনা চৌধুরী কি টের পেয়েছিলেন? কিংবা সালাহউদ্দিন লাভলু?
লাভলু একটু পরপর ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করছেন। তার অসংখ্য নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছেন ফারুক ‘ভালো মানুষ’, ‘জার্নি বাই পলিটিক্স’, ‘বাবুল স্যার’ নাম বলে শেষ করা যাবে না। লাভলু লিখছেন, ‘ফারুকের যাওয়ার সময় তো হয়নি। কতো স্বপ্ন ছিলো ফারুকের! ফিল্ম লিখবে, পাল্টে দেবে ফিল্মের স্ক্রিন। যেমন দিয়েছিলো নাটকের স্টোরি লাইন। কীভাবে বোঝাই নিজের মনকে!’
অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক সবাই ভেঙে পড়েছেন। খবর শুনে নির্মাতা হিমেল আশরাফ ছুটে গেছেন কক্সবাজার পর্যন্ত। বসে আছেন, অপেক্ষা করছেন। একই অবস্থা সৈকত নাসিরেরও। তার ‘পুলিশগিরি’ ছবির চিত্রনাট্য লিখছিলেন ফারুক। সবাই আতঙ্কিত, মর্মাহত; তবু একটা বিশ্বাসই আগলে রাখছেন- ফারুক ফিরে আসবেনই। হয়তো এমনই এক বিকেলে, ফেসবুকের দেয়ালে ভেসে উঠবে ফারুক হোসেনের পোস্ট, ‘বন্ধুরা আমি ঠিক আছি!’
বাংলাদেশ সময় : ১৬৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ