ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

আমাদের ঘরের বিনোদন

ফয়েজ রেজা (অতিথি লেখক) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
আমাদের ঘরের বিনোদন

বছর দশেক আগের কথা। পুরান ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের একজন টিকেট চেকারের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো।

  তার কুড়ি বছরের সিনেমা জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন- ‘আগে সিনেমা বানাতো শিক্ষিত লোকেরা, সিনেমা দেখতেও আসতেন শিক্ষিত মানুষেরা। তখন শিক্ষিত জজ-ব্যারিস্টারদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিলো। আর এখন! সিনেমা বানায় অশিক্ষিত লোকেরা। আর সিনেমা দেখতেও আসে অশিক্ষিত মানুষজন। ’

২০ বছরের অভিজ্ঞতা, দুই লাইনে বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণটা ছিলো কতো সরল, কতো বাস্তব। প্রিয় পাঠক, ভদ্রমহোদয়গণ, একবার ভাবুন তো- বাংলা সিনেমার দর্শক কারা? সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মুখে মুখে আছে- ‘সিনেমা হলো অশিক্ষিত লোকের বিনোদন। ’ আর আমরা যারা শিক্ষিত, তথাকথিত! তারা বাংলা সিনেমা দেখি না। দেখি হিন্দি সিনেমা। দেখি ইংরেজি সিনেমা। আর হিন্দি সিনেমাটাকে আমাদের বিনোদন ভেবে অশিক্ষিত লোকেরা যাতে দেখতে না পারে, সেজন্য সিনেমা হলে হিন্দি সিনেমা দেখানো নিষিদ্ধ করে রেখেছি। সিনেমা হলে হিন্দি সিনেমা নিষিদ্ধ না সিদ্ধ? তা এখানে আলোচ্য না। আলোচ্য আমাদের ঘরের বিনোদন।

আগে ভদ্রলোকদের কাছে প্রচলন ছিলো- ‘খেটে খাওয়া মানুষের একমাত্র বিনোদন সেক্স!’ এই কাজটি তারা বেশি বেশি করে, তাই তাদের বেশি বেশি সন্তান হয়। কথাটি যৌক্তিক না অযৌক্তিক তর্কে জড়িয়ে কাজ নেই। এখন এই কথাটি শোনা যায় না একেবারেই। গরিবের ঘরেও এখন ঢুকে পড়েছে বিনোদনের বাক্স ‘টেলিভিশন’। সিনেমা হলের নাইট শোর টিকেট তো আগেও ছিল। যাত্রাপালাটি শুধু উধাও।

এই যে বিনোদনের বাক্স টেলিভিশন, যা এখন বাংলার ঘরে ঘরে। এই বাক্সের ভেতরে আমরা কী দেখি? নাটক, সিনেমা, নাচ, গান। মুখে এ কথাটি বললাম বটে, আসলে কিন্তু আমরা দেখি ‘সার্কাস’। একই খবর পাঠ হচ্ছে নানা ঢঙে। খবর পাঠক যতো না মনোযোগ দিচ্ছেন খবর পড়ায়, তার চেয়ে বেশি করছেন স্টাইল। আর কী দেখি? খেলা। অবশ্যই ক্রিকেট। আর কী? হিন্দি সিরিয়াল। আর? আর দেখি স্টার জলসা। কী হয় সেখানে? বিকৃত রূচির ধারাবাহিক। এ প্রেম করছে তার সঙ্গে। তিনি করছেন পরকীয়া। আর তিনি করছেন সন্দেহ। এই নিয়ে যতো খুনসুটি। এই নিয়ে যতো ঝামেলা। আর এই ঝামেলা দিন দিন বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে বাড়ছে চ্যানেলটির টিআরপিও। আর বাংলাদেশের বহুজাতিক কোম্পানি সেখানে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে দর্শক ধরার জন্য।

বাংলাদেশে কয়টি টিভি চ্যানেল? গুণে গুণে হয়তো অনেক নাম বলবেন অনেকেই। কিন্তু কোন চ্যানেলে কোন অনুষ্ঠান বা কোন নাটকটি খুব জনপ্রিয়? এ প্রশ্ন যদি আসে? তথাকথিত আমি, টেলিভিশনের তরুণ কর্মী, বলতে পারবো না একটি নামও। হয়তো আপনি পারবেন? এর কী কারণ? কারণ একটাই- এ দেশে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান কিংবা নাটক এখন নাই বললেই চলে। ভালো কাজ হচ্ছে। মনে রাখছে না কেউ।

আর জি বাংলায় জনপ্রিয়? ‘মীরাক্কেল’, ‘সারেগামাপা’, ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’। আর সিরিয়াল? থাক সে কথা। পাখি ড্রেসের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা তো বাংলাদেশেই আছে। কিছুদিন আগে দেশে নতুন একটি চ্যানেল আসার খবর বেরোলেই সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যেতো ভারতের এনডিটিভি থেকে প্রশিক্ষক আসছেন, প্রশিক্ষণ দেবেন। বিবিসির নামি সাংবাদিক ট্রেনিং করাবেন। দেশের খবরের রূপ পাল্টে যাবে। যা খবর, তা তো সারাজীবনই খবর। তার রূপ কী করে বদলায়? বুঝতাম না তখন। এখন দেখে দেখে বুঝেছি- একই খবর, নানান ঢঙে নানান রঙে উপস্থাপন। যা আমাদের খবরের স্বাদের বাইরেও দিচ্ছে বাড়তি বিনোদন।

এই বিনোদন উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে টিভি চ্যানেলের কর্মী হয়ে আরেকটি কাজ আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে করছি- বসে বসে দেখছি ভারতের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ও নাটকের জনপ্রিয়তা। আর চেষ্টা করছি তাদের মতো করে নাটক বানানোর। ফল কী হচ্ছে? হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। নিজের মেধা, নিজের যোগ্যতা, নিজের সামর্থ্য সব হারিয়ে দিনে দিনে হয়ে পড়ছি রক্ত-মাংস শুন্য কঙ্কাল।

বাংলায় একটি কথা আছে- ‘মাছে মড়ক’। মাছের ধর্ম জলে ডুবে থাকা। মাছ যখন মারা যায়, ভেসে ওঠে। একটি, দুইটি, তিনটি করে, ১০-২০ এমনকি ৩০টি করে যখন অনেক মাছ মরে জলের ওপরে ভেসে ওঠে, তখনই বলা হয় মাছে মড়ক। মাছের মড়কের মতোই আমাদের মধ্যেও এখন চলছে ‘মড়ক’। আমরা এখন মরে গেছি! হয়ে পড়েছি মেধাশুন্য। ভেসে উঠছি জলে। আমাদের আত্মগর্বের এখন একটা কথাই হতে পারে- ‘মরে গেছি পচে তো যাইনি!’  আমার যারা সহকর্মী, রাতদিন খেটে চেষ্টা করছেন ভালো কাজ করার জন্য, তারা হয়তো মন খারাপ করতে পারেন কথাটি শুনে। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি- একটিু মিলিয়ে দেখুন না- যৎসামান্য কাজ যা করছি তা কী যথেষ্ট মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য? সামান্য একটু কাজ করেই আমাদের কী আত্মগৌরব। আমাদের কী আত্মতৃপ্তি। আমাদের কী মুখের ভাষা ‘ফাটিয়ে দিলাম’!

একটা কিছু হলেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস- ‘শুটিংয়ে যাচ্ছি’ কিংবা ‘শুটিং স্পট থেকে’। আর যারা একটু নামি তারকা, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলতে পারলেই আর কে ঠেকায়! কাজ একটি। স্ট্যাটাস হাজার। এতে কী হচ্ছে? আমাদের মনোযোগ যতো না কাজে, তার চেয়ে বেশি ফেসবুকে। এ তো গেলো খুব সামান্য বিনোদনকর্মীদের কথা। আর আমাদের বিনোদনের প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন? তাদের চেহারাটা দেখুন। তারা কারা? তাদের কী কাজ? নিজেদের অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ঝুঁকছেন বিদেশি অনুষ্ঠান আমদানির দিকে। কী আমদানি করছেন? এক চ্যানেলে ডোরেমন, অন্য চ্যানেল ডোরা, আরেক চ্যানেল মোটু পাতলু। হা হা হা হা। হিন্দি কার্টুন সিরিজের বাংলা ডাবিং। হিন্দি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং কবে শুরু হবে? হয়তো শিগগিরই। তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধের দেয়ালটা আরেকটু টপকাতে পারলেই।

যেভাবে দিন যাচ্ছে, এক সময় হয়তো দেখা যাবে- আমাদের বিরস সকাল থেকে মলিন দুপুরটাকে চাঙা করে রাখবে হিন্দি কার্টুন সিরিজ আর বিষণ্ন বিকেল থেকে বিমর্ষ রাতের অন্ধকারে ঝলমল আলো নিয়ে আসবে হিন্দি সিরিয়াল। আর আমরা বলবো- আমাদের চ্যানেলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, আমরাই এগিয়ে, আমাদের ব্যবসাও ভালো!



বাংলাদেশ সময় : ১৩১৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।