ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

টিভি নাটকের মন্দাবস্থা নিয়ে চিন্তিত শিল্পী-নির্মাতারা

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৬
টিভি নাটকের মন্দাবস্থা নিয়ে চিন্তিত শিল্পী-নির্মাতারা ছবি-নূর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টিভি নাটকের দীনতা ও নাজুক অবস্থায় চিন্তিত শিল্পী ও নির্মাতারা। বিজ্ঞাপনের আধিক্য, দর্শক কমে যাওয়া, পেশাদারিত্বের ঘাটতি, দায়িত্বহীনতা, অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে যোগ্য স্থানে বসানো, টিভি চ্যানেলগুলোর কর্তাব্যক্তিদের অনভিজ্ঞতা; এমন অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতারা।


নাটকে দর্শক কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে মতবিনিময় করতে বুধবার (২৭ জুলাই) সন্ধ্যায় ঢাকার গুলশান ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন অভিনেতা-নির্মাতা মাহফুজ আহমেদ। নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাণীচিত্র থেকে বিরতিহীন নাটক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। ‘ভালোবাসার প্রহর’ শিরোনামের আয়োজনটিকে সামনে রেখেই এ মতবিনিময়।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অভিনেতা-নির্মাতা তারিক আনাম খান, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, ডিরেক্টরস গিল্ডের নবনির্বাচিত সভাপতি গাজী রাকায়েত, সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিকুর রহমান, ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক হাবিবুর রহমান মোল্লা। এমন উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মাহফুজ আহমেদকে ধন্যবাদ জানান সবাই।


তৌকীর বলেন, ‘নাটকের এই ক্রান্তিলগ্নেও ভালো নাটক দেখার আগ্রহ দর্শকের আছে। এটা আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু নানান কারণে হয়তো তারা দেখছেন না। কী করলে তারা দেখবেন সেটা নিয়ে আমরা হয়তো এলোমেলো কথা বলছি, কিন্তু খুব গুছিয়ে কিছু করছি না। আমাদের নাটকের যে ঐতিহ্য আর সুনাম ছিলো সেটাকে আমরা ধরে রাখতে পারছি না এটা যেমন সত্য, সেটাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না এটা আরেকটা সত্য। ’

তৌকীরের মতে, চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু নীতিমালা দরকার। এটা নাটক ও এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য, পুরো শিল্পটিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য। তিনি আরও বলেন, ‘চীনে একটি প্রোডাকশনে ঘণ্টায় কতো মিনিট বিজ্ঞাপন যাবে সেটা সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই আমাদের অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তের সময় চলে এসেছে। সঠিক সিদ্ধান্ত ও এর বাস্তবায়ন হলে টেলিভিশন তার সম্মান পুনরুদ্ধার করতে পারে। ’

টিভি চ্যানেলগুলোকে দুষে জাহিদ হাসান বলেন, ‘চ্যানেলগুলো ঈদ এলে আমাকে বলে- অমুক ভাইয়ের (আরমান ভাই) মতো আরেকটা বানান না! কিন্তু একটার মতো তো আরেকটা হয় না। আমি তো অভিনেতা হতে চাই। নতুন নতুন চরিত্রে কাজ করতে চাই। আবার সিরিয়ালের সময় চ্যানেল বলে দেয়- একে নেন, ওকে নেন। এখন চ্যানেলের প্রোগ্রাম বিভাগের চেয়ে বেশি কথা বলতে হয় মার্কেটিং এজেন্সির সঙ্গে। কিন্তু তারা নাটক কী বুঝবেন? কোনটাতে কোন অভিনেতাকে দরকার তিনি কীভাবে বুঝবেন? এজন্য মান পড়ে গেছে, দর্শকও ভারতমুখী হয়েছে। আমার বাসার গৃহকর্মীর ভারতের সব সিরিয়ালের সময়সূচি মুখস্ত। কিন্তু আমার নাটক কবে যায় সেটাই সে জানে না! আর একটা কথা না বললেই নয়, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সাবান সুন্দরীদের খুঁজে এনে তৈরি করছি আমরা, কিন্তু টিভিতে দেখি বলিউড সুন্দরীদের! তাহলে লাভ কী হলো?’

 যোগ করে জাহিদ আরও বলেন, ‘দোষ আমাদের সবার আছে। নতুন একটা ছেলে কিংবা মেয়ে একদিন না যেতেই বলে দেয়- ভাইয়া আমি এতো ছাড়া নেই না! অথচ অভিনয়টাই ঠিকঠাক করতে পারছে না। স্ক্রিপ্ট পাঠালে সেটে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসে না। কন্টিনিটি ভুলে আসে। এটা আমাদের তরফ থেকে সমস্যা। এভাবে নাটক এগোবে কী করে? নাটকের জন্য অঙ্গীকার দরকার। আমরা যদি মনে করি সবাই একসঙ্গে আছি তাহলে সমস্যাগুলো ছোট হয়ে যায়। সবাইকে একত্রিত হতে হবে। ’


বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে তারিক আনাম খান বলেন, ‘এখন বিজ্ঞাপন নির্ভর হয়ে গেছে টেলিভিশন। চ্যানেলের কি দোষ, তাদেরকে সার্ভার ভাড়া দিতে হবে, অফিস চালাতে হবে। তাই চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক করছে কোন নাটক যাবে আর কোন নাটক যাবে না। বিজ্ঞাপনদাতাদেরকেও ভাবতে হবে, দর্শক কি বিরক্ত হন, নাকি তারা বিজ্ঞাপনটা দেখেন? পুরো অবস্থাটা সব মিলিয়ে ভালো না। মানোন্নয়ন যদি না হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে আমাদের বাজার বিদেশি চ্যানেলগুলো দখল করতে থাকবে, আমাদের তখন দেখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। ’

তারিক আনাম মনে করেন, এখন সমন্বিত আন্দোলন দরকার। তার ভাষ্য, ‘দর্শক তো বোকা না, তারা কেনো আমাদের নাটক দেখেন না? বিরতিহীন হলেই দর্শক নাটক দেখবে এই তত্ত্বে আমি একমত নই। দর্শকের মনে যদি জায়গা করে নেওয়ার উপকরণ না থাকে তাহলে লাভ নেই। সুতরাং অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনার ব্যাপার আছে, সংলাপ করার ব্যাপার আছে। ’

একই অভিমত ব্যক্ত করলেন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়েত। তার মতে, ‘কনটেন্ট যদি ভালো হয় তাহলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মান যদি ঠিক থাকে, কনটেন্ট ভালো হলে দর্শক বাইরে যেতে পারবে না। তখন দর্শক নাটকও দেখবে, বিজ্ঞাপনও দেখবে। ’

বিজ্ঞাপনের নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি বলেন, ‘এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির সময়। এই অবস্থায় দর্শককে আটকে রাখা যাবে না। তবে সব পাখি ঘরে ফেরে। ফিরে আসতে হয়। আমাদের দর্শকরাও বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরে নিজেদের সংস্কৃতিতে এসে ঘুমাতে চায়। কিন্তু তাকে আমরা ঘরে ফিরতে দেই না। দর্শক যখন ঘরে ফিরতে চায় তখন বিজ্ঞাপনের অত্যাচার, টক শো ও চ্যানেলগুলোর অপরিকল্পিত অনুষ্ঠানের কারণে আর ঘরে ফিরতে পারে না। তখন তারা অপসংস্কৃতি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। গত ৮-১০ বছর ধরে এভাবে আমাদের দর্শকরা বেরিয়ে গেছে। ’

‘ভালোবাসার প্রহর’-এর মতো উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে উল্লেখ করে গাজী রাকায়েত বলেন, ‘আমি মাহফুজ আহমেদকে সাধুবাদ জানাই। এটাই একজন হিরোর পদক্ষেপ। এ ধরনের প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা যদি দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে পারি তা সবার জন্যই ইতিবাচক হবে। এখন সব পাখিরা বিভিন্ন চ্যানেলে ঘোরাঘুরি করছে, তাদেরকে ফেরানোর জন্য বিরতিহীন নাটকের প্রয়োজন আছে। ’


গাজী রাকায়েত মনে করেন, ভালো নাটক বানাতে গেলে শিল্পী ও পরিচালকদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবে দেখতে হবে। রাত দুইটায় ফিরে পরদিন সকাল আটটায় আবার যেতে হলে অভিনয়টা ভালো হবে না। তার কথায়, ‘আমরা অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজকরা মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে সই করেছিলাম। কখন শুটিং শুরু করবো, কখন শেষ করবো, এরকম ৪০টি পয়েন্ট আছে সেখানে। এখন শুধু পালন করা দরকার। ’
 
নাটকের কলাকুশলীদের চুক্তি করতে হয় না বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন গাজী রাকায়েত। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এটা কেমন মাধ্যম? যে মাধ্যমে কোনো চুক্তিনামা স্বাক্ষর হয় না। বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্রে কাজ করতে গেলে চুক্তি করতে হয়। কিন্তু নাটকেই একমাত্র এ নিয়ম নেই। যারা চুক্তিনামা রক্ষণাবেক্ষণ করবে না ডিরেক্টরস গিল্ডে তাদের শিডিউল ফাঁসানোসহ কোনো অভিযোগই নেওয়া  হবে না। বোঝাপড়ার মধ্যে এটা করা যাবে বলে মনে হয়। ’

ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এসএ হক অলিক তাদের সংগঠনের সদস্য নন এমন কারও নাটক প্রচার না করার জন্য টিভি চ্যানেলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা চ্যানেল, এজেন্সি, কাউকে আলাদা করে দেখছি না। এখানে একা কেউ কিছু করতে পারবে না। নতুনদের নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা এ শিল্পকে গোছাতে এসেছি। শৃঙ্খলা না থাকলে মান ভালো হবে না। দায়িত্বহীনতার অভিযোগ এলে আমরা তাদের মানসিকতা পরিবর্নের চেষ্টা করবো। ’


চলমান সমস্যা আর প্রতিকূলতা প্রসঙ্গে আরটিভির সিইও বলেছেন, ‘আমরা হয়তো একীভূত হতে পারছি না বা সমন্বিতভাবে শিল্প, নাটক, কলাকুশলীদের জন্য জরুরি কথাগুলো বলতে পারছি না। আমাদের আসলে একসঙ্গে কাজগুলো হওয়া জরুরি। আমরা অনেক অসম প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চলছি। সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হবে। বিজ্ঞাপনদাতারা মনে করেন টানা পাঁচ মিনিট বিজ্ঞাপন দিলে দর্শকরা সব দেখছে, কিন্তু তারা যে বিজ্ঞাপন আসার পরপরই অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে সেটা তারা খেয়ালই করেন না। এটা তাদেরকে আমরা ধীরে ধীরে বোঝাচ্ছি। ’

অনুষ্ঠানে অতিথি সারিতে ছিলেন অভিনেত্রী সাদিয়া ইসলাম মৌ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, শবনম ফারিয়া, তারকা দম্পতি এফএস নাঈম-নাদিয়া আহমেদ, ডিরেক্টরস গিল্ডের সহ-সাধারণ সম্পাদক হৃদি হক, অভিনেতা মাজনুন মিজান, মিশু সাব্বির, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, আবু হায়াত মাহমুদ, সাইদুর রহমান রাসেল, ইমরাউল রাফাত, মাবরুর রশীদ বান্নাহ, নাট্যকার পান্থ শাহরিয়ার, প্রযোজক আলী বশির ও শামীমা শাম্মী দম্পতি।

জানা গেছে, ‘ভালোবাসার প্রহর’-এর অংশ হিসেবে শুক্রবার (২৯ জুলাই) রাত ১১টা ২০ মিনিটে বিজ্ঞাপন বিরতি ছাড়াই প্রচার হবে ‘অভিনেতার অভিনয়’ (তারিক আনাম খান, জাহিদ হাসান, মৌসুমী হামিদ)। আর আগামী ৫ আগস্ট থাকবে ‘বোকা বাক্স’ (আনিসুর রহমান মিলন, তিশা)। দুটোই পরিচালনা করেছেন আবু হায়াত মাহমুদ। অনুষ্ঠানে দুটি নাটকের প্রোমো দেখানো হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৬

জেএইচ/এসও 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।