বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার মতো মহানায়ক আর আসবেন না। সব শ্রেনীর দর্শককে আপন করে নিয়েছিলেন উত্তম কুমার।
রোমান্টিক নায়ক নন, ব্যতিক্রমী অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম। সেসব ছবি অভিনেতা হিসেবে তাকে সার্থক প্রমাণ করেছে। ছবিগুলো যুগ যুগ ধরে তার অভিনয়ের স্মারক হয়ে আছে। তার বহুরূপী অভিনয়ের গুণকীর্তন তাই দিকে দিকে।
অষ্টাদশ শতকের ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনি। তার ওপর ছবি তৈরি হবে। কে হবেন সেই কবি? নির্বাচন করা হলো উত্তমকে। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তার বিপরীতে ছিলেন তনুজা। একজন কবির আবেগ, হতাশা, যন্ত্রণা, কবির লড়াইয়ে উত্তেজনা- সবই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন উত্তম।
‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবির উন্মত্ত তরুণ থিরুমলের চরিত্রটি আর কে এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন? বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিতে গৃহভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে উত্তমের অসাধারণ অভিনয় সবার মনে দাগ কাটে। বিমল মিত্রের উপন্যাস নিয়ে ‘স্ত্রী’ ছবিতে লম্পট অথচ সরলমনা জমিদারের চরিত্রেও তিনি অনন্য। তিনি এখানে খলনায়ক হয়েও প্রধান ভূমিকায়। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বিচারক’ অবলম্বনে তৈরি ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। বিচারকের মনোজগতের দ্বন্দ্ব সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি।
‘মায়ামৃগ’ ছবিতে করেছিলেন পার্শ্ব চরিত্র। তাকে কী? সেখানেও দৃষ্টি কেড়ে নেন। ‘শেষ অংক’ ছবিতে তিনিই যে স্ত্রীর হত্যাকারী এ বিষয়টি দর্শককে চমকে দেয়। ‘সপ্তপদী’তে ফাদার কৃষ্ণেন্দ, ‘অগ্নিশ্বর’ ছবির চিকিৎসক, ‘নিশিপদ্ম’ ছবির মাতাল, ‘থানা থেকে আসছি’র ইন্সপেক্টর, ‘দেবদাস’র চুনিলাল এসব চরিত্র নায়ক উত্তমকে নয় বরং অভিনেতা উত্তমকে তুলে ধরে। ‘আমি, সে ও সখা’ ছবিতে চিকিৎসক সুধীরের ভূমিকায় তার অভিনয়ও ছিলো অসাধারণ।
সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন দারুণ মানানসই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে ‘গৃহদাহ’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘কমললতা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথের দাবী’ ও ‘বড়দিদি’তে তিনি নায়ক চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন। এগুলোতে তথাকথিত নায়োকোচিত অভিনয় করেননি তিনি। এর মধ্যে পাঁচটিতেই তিনি জুটি বেঁধেছিলেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।
কমেডিতেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে তার অভিনয় নির্মল হাসির খোরাক দেয় দর্শককে। ‘দেয়া-নেয়া’, ‘নবজন্ম’ ছবিতেও কমেডি চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘নবজন্ম’ ছবিতে নিজের কণ্ঠে কয়েকটি গানও গেয়েছিলেন উত্তম। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী। ‘অভয়ের বিয়ে’ সিনেমায় জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও সরল ধনাঢ্য যুবক অভয়ের ভূমিকায় উত্তমের কমেডি ছিলো অনবদ্য। তবে উত্তমের সেরা কমেডি বলা যায় শেক্সপিয়রের নাটক ‘কমেডি অফ এররস’ অবলম্বনে নির্মিত ‘ভ্রান্তি বিলাস’ সিনেমাটিকে। এখানে উত্তম কুমার ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যাযের দ্বৈত অভিনয় ছিলো অনন্য।
উত্তম কুমারের ছবির সংখ্যা কতো? ২০২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকবাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট ও ৫৭টি ছবি ব্যবসা সফল। শক্তি সামন্ত পরিচালিত উত্তম অভিনীত হিন্দি ছবি ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সুপারহিট হয়। এ দুটি ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় ছিলেন অসাধারণ। ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে বছর (১৯৬৭) তিনি সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬১ সালে ‘দোসর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ‘হারানো সুর’, ‘হ্রদ’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অমানুষ’, ‘বহ্নিশিখা’ ছবির জন্য ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।
অনেকের মতে, উত্তম অভিনীত অধিকাংশ ছবিই মেলোড্রামাটিক, বিশ্বমানের নয়। তাতে কী? আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা বলা হয় তাকে। ‘স্পেল বাউন্ডে’ গ্রেগরি পেকের অভিনয়ের সঙ্গে তুলনায় ‘হারানো সুর’-এর উত্তম কোনো অংশে কম নন। ‘ওগো বধূ সুন্দরীতে’ তিনি কোথাও কোথাও ‘মাই ফেয়ার লেডি’র রেক্স হ্যারিসনকেও অতিক্রম করে গেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারা পাল্টে দেন। লাউড (চিৎকারসর্বস্ব) অভিনয়ের ধারা পাল্টে তিনি আন্ডারটোন (নিচুস্বর) ও স্বাভাবিক অভিনয়ের ধারার সূচনা করেন।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৬
এসও