এবারের ঈদ উপলক্ষে নির্মিত নাটক ও টেলিছবির মধ্যে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো, বেশকিছু গান অবলম্বনে কাজ করেছেন নির্মাতারা। জনপ্রিয় গানের ভাবনা নিয়ে নাটক নির্মাণের প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এ তালিকায় আছে- শিহাব শাহিনের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, আবু হায়াত মাহমুদের ‘আমার হিয়ার মাঝে’, মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘কেনো এই নিঃসঙ্গতা’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘এ কি সোনার আলোয়’, মাহমুদুর রহমান হিমির ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’, গৌতম কৈরীর ‘এখন তো সময় ভালোবাসার’ ও ফরহাদ আহমেদের ‘আগে যদি জানতাম’। এ ছাড়া ছয়টি নাটক নিয়ে পরিচালক অনন্য ইমন বানিয়েছেন ‘এক মুঠো ভালোবাসা’ নামের একটি ধারাবাহিক।
জনপ্রিয় গান নিয়ে নাটক তৈরির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মৌলিক গল্পের অভাব নাকি গানগুলোর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করা হচ্ছে তা জানতে বাংলানিউজ কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট নির্মাতাদের সঙ্গে। তাদের প্রায় সবারই ভাষ্য, গানের কথাগুলোর পেছনেও যে একেকটি গল্প থাকে তা ফুটিয়ে তুলতেই তৈরি হয়েছে এসব নাটক। এ ছাড়া জনপ্রিয় গানগুলোর ব্যবহারের ফলে দর্শকদের মধ্যে বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হয়।
জনপ্রিয় বাংলা গানগুলো অবলম্বনে নাটক তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে নির্মাতাদের ভাষ্য, টিভি চ্যানেল থেকেই নির্বাচন করে দেওয়া প্যাকেজ এটি। পরিচালক শিহাব শাহীনের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ যাবে জিটিভির ‘রোমান্টিক ড্রামা ফেস্ট’-এ। তিনি বললেন, ‘এই আইডিয়াটা পুরোপুরি ভিন্ন মনে হয়েছে আমার। ঈদে সব মিলিয়ে ৩০০ নাটক প্রচার হবে টিভি চ্যানেলগুলোতে। এর মধ্যে গান অবলম্বনে ১৩টি নাটক দর্শকদের ভিন্ন স্বাদ এনে দিতে পারে। দর্শক যেমন চলচ্চিত্রে গান দেখতে চায়, তেমনি নাটকেও তারা গান দেখলে খুশি হয় বলে আমি মনে করি। ’ তিনি মনে করেন, নাটকগুলো দর্শকপ্রিয়তা পেলে আগামীতে গান অবলম্বনে নাটক তৈরির প্রবণতা বাড়তে পারে।
এই ভাবনা অবশ্য তরুণ নির্মাতা অনন্য ইমনের কাছে নতুন নয়। গত বছর এসএ টিভির জন্য ‘রেইন ফরেস্ট’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটক বানিয়েছিলেন তিনি। এর ১৫৩ পর্বে লোকজ, রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক বাংলা, ইংরেজি ক্ল্যাসিক গান অবলম্বনে সাজানো ৩৮টি গল্প প্রচারিত হয়।
এবার চলচ্চিত্রের ছয়টি জনপ্রিয় গান নিয়ে একটি ধারাবাহিক নাটক বানিয়েছেন অনন্য ইমন। তিনি বলেন, ‘গান অবলম্বনে নাটক তৈরির প্রবণতা বাড়ছে কি-না তা জানি না। যেহেতু আগেও গান নিয়ে নাটক বানিয়েছি, তাই এবারের ভাবনা আমার ব্যক্তিগত। দর্শক বিভিন্ন ছবিতে এই গানগুলো দেখেছেন, কিন্তু এগুলো দিয়েও যে ভালো কিছু গল্প সাজানো যায় সেটাই চেষ্টা করেছি। ’
এসব নাটকে সংশ্লিষ্ট গানগুলোর সঙ্গে নতুন গল্পের সেতুবন্ধন খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে কথা বলেছেন পরিচালক গৌতম কৈরী। তার কথায়, “গানের সঙ্গে গল্পের মিল যদি দর্শক খুঁজে না পায় তাহলে সেটাকে গানের ভাবনা নিয়ে নাটক বলা যাবে না। গান নিয়ে নির্মিত নাটকের বিষয়বস্তু অবশ্যই গানের মূলভাবনাকে কেন্দ্র করে ফুটিয়ে তোলা উচিত। আমাদের পরিচিত গানগুলো শুনলে সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত ঘটনাগুলো সামনে আসে। যেমন, আমার নাটকটি হলো ‘এখন তো সময় ভালোবাসার’। এই গানটি শুনলেই দর্শকদের চোখে ভেসে ওঠে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে সালমান শাহ ও মৌসুমীর বনে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। তাই চেষ্টা করেছি ওই গানটির ঘটনাকে উপজীব্য করে কাছাকাছি একটি ঘটনাকে সৃষ্টি করতে। ”
এ কথার রেশ ধরে পরিচালক মিজানুর রহমান আরিয়ানের মতে, একেকটি গান শুনে শ্রোতারা একেকটি গল্প কল্পনা করেন। কখনও কখনও নিজেদের জীবনের সঙ্গে গানের কথা মেলানোর চেষ্টা করেন অনেকে। এরই সূত্র ধরে জনপ্রিয় গান অবলম্বনে নির্মিত নাটকগুলোতেও দর্শক ভিন্ন কয়েকটি গল্প দেখবে বলে মন্তব্য তার। তিনি বলেছেন, ‘এবারই প্রথম গান অবলম্বনে নাটক তৈরি করলাম। দর্শকপ্রিয়তা পেলে অবশ্যই অনুপ্রাণিত হয়ে আবার এরকম কাজ করবো। জিটিভি থেকে প্রস্তাবটি পাওয়ার ২০টি গানের মধ্য থেকে ‘কেনো এই নিঃসঙ্গতা’ বেছে নিয়েছি। ছোটবেলায় ক্লাসে বসেও লুকিয়ে গানটি শুনতাম। সবারই প্রিয় কিছু গান থাকে যেগুলোর সঙ্গে এককটি ঘটনা জড়িয়ে আছে। প্রিয় গানটির সঙ্গে মিলিয়ে একটি মৌলিক গল্পে নাটকটি তৈরি করেছি। ’
কালজয়ী কিংবা জনপ্রিয় গান অবলম্বনে নাটক তৈরির প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ছোটপর্দার নির্মাতারা। তাদের ভাষ্য, নাটকে ব্যবহারের ফলে এ প্রজন্মের দর্শক-শ্রোতারা এই গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গ টেনে পরিচালক মাহমুদুর রহমান হিমি বললেন, ‘জনপ্রিয় অনেক গান নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এর ব্যবহার দরকার। এজন্য যদি গানগুলো নাটকে ব্যবহার হয় কিংবা এসব গানকে সম্বল করে গল্প লেখা হয় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। ’
নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী জানালেন, গান অবলম্বনে নাটক তৈরির বিষয়টি নতুন নয়। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’র মতো জনপ্রিয় গান অবলম্বনে নাটক তৈরি হয়েছে আগে। তিনি বললেন, ‘এই গানগুলো এতোটাই জনপ্রিয় যে এখনও আমাদের কানে বাজে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও গানগুলোকে পরিচর্যা করা উচিত। যদি এসব গান অবলম্বনে ভালো কিছু গল্প দর্শককে দেখানো যায় তাহলে মন্দ কি! তবে গানের সারমর্ম যেন ঠিক থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে আমাদের। ’
প্রশ্ন উঠেছে, গানগুলোর গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পীর অনুমতি নেওয়া হচ্ছে কি-না। পুরো গান ব্যবহার না হলেও যেহেতু গানগুলো অবলম্বনে গল্প সাজানোর প্রবণতা চলছে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা ন্যূনতম সৌজন্যতা প্রত্যাশা করতেই পারেন।
পরিচালক আবু হায়াত মাহমুদও মনে করেন, গানগুলোর মূল শিল্পীদের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া উচিত। তিনি বললেন, ‘তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ না জানানো হলে অসৌজন্যতা হবে। যতোদূর জানি, জিটিভি থেকে শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমার নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। ’ যোগ করে তিনি বলেন, ‘গান অবলম্বনে নাটক তৈরির ফলে এসব জনপ্রিয় গানের পরিচর্যা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি গানগুলোর সূত্র ধরে মৌলিক কিছু গল্প বেরিয়ে আসছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৬
জেএমএস/জেএইচ