ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

জীবন আমাকে ক্ষমাশীল আর ভুলে যেতে শিখিয়েছে: ফারুকী

সোমেশ্বর অলি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
জীবন আমাকে ক্ষমাশীল আর ভুলে যেতে শিখিয়েছে: ফারুকী মোস্তফা সরয়ার ফারুকী-ছবি: রাজীন চৌধুরী, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দেশীয় চলচ্চিত্রে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। সব শ্রেণির দর্শকই হলে গিয়ে ছবি উপভোগ করার উপলক্ষ্য পাচ্ছে। এই যাত্রায় সামিল হচ্ছে বহুল আলোচিত ছবি ‘ডুব’ (নো বেড অব রোজেস)। একইসঙ্গে দেশ ও বিদেশে আলোচনা জিইয়ে রাখছে ‘ডুব’। আন্তর্জাতিক কয়েকটি উৎসবে বিদেশিরা দেখেছেন ছবিটি, প্রশংসা ও পুরস্কারও জুটেছে এর ভাগ্যে। এবার দেশের আপামর জনতার কাঠগড়ায় ‘ডুব’।

শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) বাংলাদেশ-ভারতে ‘ডুব’-এর মুক্তি। ‘ডুব’কে প্রসঙ্গ করে বাংলানিউজের সঙ্গে বহুমাত্রিক আলাপ হলো জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে।

২১ অক্টোবর (শনিবার বৃষ্টিমুখর দুপুরে) এই নির্মাতার বনানীর বাসায় জম্পেশ আড্ডা হলো। পড়ুন ফারুকীর সাক্ষাৎকার—

বাংলানিউজ: চলচ্চিত্রের সঙ্গে দর্শক সম্পৃক্ততা বাড়ছে, হলে দর্শকের উপস্থিতি দেখে সেটা বোঝা যেতে পারে। ‘আয়নাবাজি’র পর সবশেষ ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সেটা প্রমাণও করে। এ ক্ষেত্রে আপনার ‘ডুব’ নিশ্চয়ই ভালো দর্শক টানবে? তেমন নমুনা অবশ্য দেখাও যাচ্ছে…
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: দুটি দিক আছে। প্রথম দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের যে কোনো ছবি যখন ব্যবসা করে (সেটা হোক ঢাকা অ্যাটাক, শিকারী, আয়নাবাজি, হিরো নাম্বার, মনপুরা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, পোড়ামন) তখন ইন্ডাস্ট্রির ব্লাড লাইনে খুব দারুণ একটা ফ্লো আসে। যেটার বেনিফিট মেইনস্ট্রিম ফিল্ম মেকাররা যেমন পায়, অঁতর ফিল্ম মেকাররাও পায়। ফলে এটা ইন্ডাস্ট্রির সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। এটা গেলো একটা দিক। আর ‘ডুব’ এর প্রসঙ্গ হচ্ছে যে, যারা আমার কাজ দেখে অভ্যস্ত, যারা আমার কাজ সম্পর্কে জানে, তারা নিশ্চয়ই জানে যে, আমার কাজ আমার মতোই। ভালো লাগলেও আমার মতো, খারাপ লাগলেও আমার মতো। যে রকম আল মাহমুদের কবিতা আল মাহমুদেরই মতো। বিনয় মজুমদারের কবিতা বিনয় মজুমদারেরই মতো। আমি যেমন হ্যা, আমার গল্পের সঙ্গে অনেক মানুষ এনগেইজড হয়, তাতে আমি আনন্দ বোধ করি। অনেক মানুষ আমাকে ভালোবাসা জানায়, তাতে আমি আনন্দ বোধ করি। দোকানে পাটে রাস্তা ঘাটে গেলে তারা এসে তাদের ভালোবাসার কথা জানায়। কোন ছবির কোন অংশ ভালো লেগেছে, দৃশ্য ধরে ধরে বলে, এটা আমি উপভোগ করি। এবং আমার দর্শক সংখ্যা যতো বাড়বে আমি ততোই আনন্দিত হবো। আমার প্রথম কাজ ‘ওয়েটিং রুম’ হয়তো দু’শো লোক দেখেনি। কিন্তু আস্তে আস্তে যে এটার দিগন্ত বেড়েছে, তাতে আমি খুবই আনন্দিত। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য কথা যে, দর্শকের নাম্বার মাথায় রেখে আমি কাজ করি না। নাম্বার মাথায় রেখে কাজ করলে বিপদটা হচ্ছে যে, তুমি তখন তোমার নিজের গল্প বলতে পারবে না। তখন দর্শক যে গল্পটা দেখে অভ্যস্ত সেটা বানাতে হবে। তাহলে তো প্রথমে আমি ‘ব্যাচেলর’ বানাতাম না, প্রথমে মেইনস্ট্রিমে যেভাবে গল্প বলে আমি সেটাই বলতাম। কিন্তু সেটা আমি চেষ্টাও করিনি। দর্শক যে সিনেমা দেখে অভ্যস্ত, সেটাই বানাতে হবে— আমি এই তরিকায় বিশ্বাস করি না। সিনেমা আমার কাছে ওয়ার্ক অব আর্ট। আমি জানি যে, ওয়ার্ক অব আর্ট কোনো ফর্মুলায় চলে না। যেমন একেকজন একেক রকম গান লেখে…। কিন্তু যারা এটা (মেইনস্ট্রিম সিনেমা) বানাচ্ছে তাদের প্রতি আমার কোনো অশ্রদ্ধা নেই। ইন্ডাস্ট্রির জন্য সবকিছুরই দরকার আছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে খটকা লাগে, কিছু কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিও বলে ফেলেন যে, ছবি আসলে এভাবে বানাতে হবে, এই ফর্মুলার মধ্যে…দ্যান ইট ইজ ডেঞ্জারাস…।    
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীবাংলানিউজ: এটা তো ঠিক যে সর্বাধিক হলে যাচ্ছে ‘ডুব’...
ফারুকী: এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, প্রথম কথা হচ্ছে, আমি সবসময় দর্শক চেয়েছি। কিন্তু দর্শক চাওয়ার জন্য আমি আমার কণ্ঠস্বরকে লিমিট করার চেষ্টা করিনি, সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করিনি।   আমি নিজেকে ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করিনি। আমি দর্শক চেয়েছি, কিন্তু আমি আমার গল্পটা আমার মতো করে দেখাতে চেয়েছি, বলেছি। মানে, দর্শকের কথা ভেবে আমি আমার বলবার ভঙ্গি বদলাতে রাজি হইনি। এটা এক…। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যে, হলের ব্যাপারে বলি…একটু আগেও বলেছি আমি কখনো সংখ্যা দ্বারা পরিচালিত না। যদি তা হতাম তাহলে ‘ব্যাচেলর’ বানানোর পর আরেকটা ‘ব্যাচেলর’ বানাতাম। বা ‘থার্ড পারসন’…বা ‘টেলিভিশন’-এর পর আরেকটা ‘টেলিভিশন’ বানাতাম। সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। কিন্তু এরপর আমি বানিয়েছি ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, সাচ এ ডার্ক স্টোরি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার ছবির জন্য ৪০টি হল মোর দ্যান গুড এনাফ। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি বলি, আমরা জানি যে সারাদেশের সিনেমা হল থেকে যে টাকা আসে তার বেশির ভাগ, ৬০ ভাগের বেশি টাকা আসে ঢাকার পাঁচটি হল থেকে। নাম্বার অব হল বাড়ালেই যে আমার সিনেমা ব্যবসাসফল হবে বা মহৎ হবে ব্যাপারটা তা না।

বাংলানিউজ: এ ক্ষেত্রে ‘ডুব’-এর বাজেট প্রসঙ্গ চলে আসে।
ফারুকী: আমার বাজেট সম্পর্কে কোনো ধারনা নাই। কারণ বাজেটটা প্রডিউসারেরা জানে। আমি শুধু আমার ছবিটা বানিয়েছি।  

বাংলানিউজ: এটা তো ঠিক ‘ডুব’ আপনার সর্বাধিক বাজেটের ছবি?
ফারুকী: তা তো বটেই। কারণ ইরফান খানের নিজেরই ফি আছে অনেক টাকা।  

বাংলানিউজ: ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ কম বাজেটের ছবি। হয়তো আরো বড় শিল্পী নিয়ে বানাতে পারতেন। পারেননি। ‘ডুব’-এর ক্ষেত্রে আপনি পছন্দের অভিনয়শিল্পীদের নিতে পেরেছেন। এজ আ ডিরেক্টর দুই ছবির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন নিশ্চয়ই?
ফারুকী: আমি মনে করি, বাজেটের সঙ্গে ছবির গুণাগুণের কোনো সম্পর্ক নাই। অনেক বড় বাজেটে খুব বাজে একটা ছবি বানানো যেতে পারে। আবার অনেক কম বাজেটেও অসাধারণ ছবি বানানো যেতে পারে। ছবিটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করছে আমি কী বলতে চাই, কিভাবে বলতে চাই তার ওপর। বাজেট নিশ্চয়তা দেয়না ছবি ভালো হবে কী খারাপ হবে। প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রে আমার কাজের মেজাজ ও ঢং একই রকম। তবে হ্যা, একেকটা ছবির একেকটা বৈশিষ্ট্য থাকে। ‘ডুব’-এর ট্রেলার দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, এই ছবিটা স্থিত ধী ছবি, যেটা মানুষের জীবনের গহীন-গোপন অনুভূতির কথা বলে। খুব শীতল অনুভূতির কথা বলে। একটা ঝিম ধরে আসে। শীতের দিনে যখন আমরা রোদ পোহাই, তখন যেমন ঝিম ধরে আসে...এই গল্পটাও যেন ঝিম ধরা গল্প, যেটা মানুষের অসহায়ত্বের কথা বলবে, হল থেকে বের হওয়ার সময় আমরা অসহায়ত্ব নিয়ে বের হবো। আমার মনে হয়, গল্পটা কেমন সেটার ওপর স্টাইলও নির্ধারিত হয়ে যায়, শুটিংয়ের পরিবেশও নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন ‘টেলিভিশন’ খুব মাস্তির মধ্যে শুট করেছি, কারণ গল্পটাই তেমন। ‘ডুব’ হাউমাউ কান্নার ছবি না। যেখানে নৈঃশব্দ নিজেও একটা চরিত্র। ফলে এর শুটিংয়েও ধ্যানমগ্ন থাকার ব্যাপার ছিলো।

বাংলানিউজ: ‘আহারে জীবন’ গানের লিরিক শতাধিকবার কারেকশন করিয়েছেন। আপনি তো কবিতা চর্চা করতেন, নিজে লিখে ফেললেই পারতেন…!
ফারুকী: হা হা হা। পরিচালকরা সকল কাজের কাজি। কিন্তু কোনো কাজে এক্সপার্ট না। আমার ছবির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ই আমি ঠিক করি। তাই বলে আমিতো সিনেমাটোগ্রাফিটা করিনা, আমি তো এডিটিংটা করিনা। এর কারণ আমি ওটার জন্য উপযুক্ত না। কিন্তু আমি কী চাই, সেটা আমি জানি। গানের ক্ষেত্রেও একই, কিন্তু কেমনে এটা লিখতে হবে সেটা আমি জানি না। ফলে আমার সব গান লেখার ক্ষেত্রে যেটা ঘটে, আমি হয়তো ভাবটা বলি, কখনো কখনো দু’ একটা ইমেজ বলি, একটা দুটো শব্দ ছুঁড়ে মারি, যাতে যিনি লিখবেন, যেন অন্ধকারের মধ্যে ইমেজটা ধরে পুরো কাব্যটা যেন পেয়ে যায়।    

বাংলানিউজ: ঠিক কখন গানটা আপনার মনে ধরলো?
ফারুকী: আমি নিজে বারবার ব্রিফিং চেঞ্জ করছিলাম, এ কারণে সময় বেশি লাগছিলো। এটা কেন হচ্ছিলো এখন আমি বলতে পারি। আমি এই ছবিটি এক বছর ধরে এডিট করেছি। কিছুদিন পরপর আমি এডিটিং স্ট্রাকচার চেঞ্জ করছিলাম। এর সাথে সাথে ছবির বক্তব্যও চেঞ্জ হচ্ছিলো, আগাগোড়া। এই ছবি প্রথম যে দেখেছে, সে যখন শেষবার দেখেছে, দুইটা আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই যে বারবার এডিটিং স্ট্রাকচার চেঞ্জ হচ্ছিলো এটা ছবিটার সুরও চেঞ্জ করছিলো। যখন মূল সুর বদলাচ্ছে তখন তো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যেটা ছবির একমাত্র গান, যেটা ছবির সামারি ক্যারি করবে, সেটাও বদলানো। যতোখানি সুমী আপার দোষ, দোষও না, আমি বারবার ব্রিফিং চেঞ্জ করছিলাম। ফাইনালি যখন এডিটিং লক হয়েছে, তখন আমি জানলাম আমি এটা চাই।     

বাংলানিউজ: ‘ডুব’ ছবির ক্ষেত্রে আপনাকে বেশ জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা কী উপভোগ্য?
ফারুকী: আমার জীবনে এখনও বহুদূর যাওয়া বাকি আছে। আমি জানি আমি বহুদুর যেতে পারবো ইনশাল্লাহ। এবং আমি কিছুই এচিভ করিনি, এটাও আমি জানি। নিরানব্বইতে আমি প্রথম কাজ করেছি, সেই হিসেবে ১৮ বছর হয়ে গেলো। এই ১৮ বছরে আমি স্রোতের উল্টো দিকে দাঁড় বেয়েছি। যখনই কেউ নতুন কিছু একটা নিয়ে আসে, তখনই আমরা তাকে আক্রমণ করতে চাই এই কারণে, নতুন কিছু আমাদের আগের অভিজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জ করে। যখনই চ্যালেঞ্জ করে তখন আমি ভাবি এটা আমার ব্যক্তিত্বকেই আঘাত করেছে, তখন আমি আহত হয়ে আক্রমণ করতে শুরু করি। এটা নতুন কিছুকে ধারণ করার অনীহা থেকে আসে। আমি শুরু থেকে এগুলোর উত্তর দিয়ে আসছি। ভাষা, পেশাদার অভিনেতা কেন নিচ্ছেন না? ইত্যাদি অভিযোগ। তারা বলে, আরে আমরা তো ভালো ছবি মনে করছিলাম যে, গ্রাম, গঞ্জ, দুঃখ-দারিদ্র, নারী…এসবের বাইরে কেন বিষয় নিচ্ছেন? এরপর যখন তথাকথিত জনপ্রিয় হলাম, তখন বলা শুরু করলো আপনি কেন জনপ্রিয়? যখন আর কিছুতে ঠেকাতে পারেনা, তখন বলে উনারটাতো সিনেমা না, টেলিফিল্ম। তারপরে এটাতেও যখন আটকানো যাচ্ছেনা, কারণ পৃথিবীর বড় বড় ফিল্ম ক্রিটিকরা প্রশংসা করছে, তখন হয়তো আরেকটা নতুন কিছু বের করে ফেলবে। আমি ওসবে মাথা ঘামাইনা। আমি নিজেকে আবিষ্কারের ধ্যানে আছি।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীবাংলানিউজ: অনেকে বলে যে, আপনার ছবি দেশে চলে না, দেশের বাইরে চলে…
ফারুকী: হ্যা, হ্যা, দুই দিন আগে এরাই আমাকে বলতো, আরে ফারুকী তো জাস্ট জনপ্রিয় নির্মাতা। সে যথেষ্ট সিরিয়াস ফিল্মমেকার না। এখন বলছে, হ্যাঁ জনপ্রিয়, কিন্তু ইয়াংদের মধ্যে। সাধারণ দর্শকের কাছে তো জনপ্রিয় না। কে যে সাধারণ আর কে যে অসাধারণ, আল্লাই জানে। আমার ধারণা সত্যজিৎ রায়কে পেলেও ওরা টেনে নিজেদের কাতারে নামিয়ে আনতো। বলতো, আপনি ফিল্ম বানাইতে হলে ‘জুম্মন কসাই’ বানাইতে হবে। সাধারণ দর্শকের জন্য ছবি না বানাইলে কিসের ফিল্মমেকার?

আমার কথা যদি বলেন, আমি তো বলি শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমি  বাংলাদেশের একজন নগন্য ফিল্ম মেকার, যে প্রচলিত সব পথ অস্বীকার করেছে। সেখানে আমার ছবি দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষ হলে যায়, তারা আমায় ভালোবাসে, রাস্তায় বের হলে তারা ভালোবাসার কথা জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিঠি লেখেন, দোয়া করেন যেন আমি সুস্থ থাকি...এটা তো বিরল জিনিস। এইখানেই বাংলাদেশের শক্তি নিহিত। ২০১০ সালে আমি রটারডেমে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, এশিয়ান ফিল্ম মেকারদের নেটওয়ার্ক, ওখানে ফিলিপচিয়া, টুক চং…আরও অনেকে ছিলেন…ওখানে আমার ওকে কাটটা দেখেছিলো, হাজার হাজার মানুষ হলে যাচ্ছে, আমার ‘থার্ড পারসান সিঙ্গুলার নাম্বার’ দেখছে...। তারা অবাক হয়ে বলেছে, এতো লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ছবি দেখতে? আমরা তো ভেবেছিলাম বাংলাদেশ একটা পানিতে ডোবা দেশ, শিক্ষাদীক্ষা নাই…এরকম একটা ধারনা ছিলো। আমি তখন হেসে বললাম, আমাদের জনসংখ্যা বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বিশাল একটা তরুণ জনগোষ্ঠী বড় হয়েছে আমার ছবির ক্যারিয়ারের সমান্তরালে। এরা সারা পৃথিবীর ছবি দেখে। এরাই আমাদের মূল শক্তির জায়গা। এরই পরিবর্তনটা আসন্ন করছে। এই যে ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার বা স্ক্রিন ডেইলি আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের ডিরেক্টরদের ধর্তব্যে আনে, এটা সম্ভব হয়েছে এসব দর্শকের জন্যই। এরাই আমাকে বা আমাদের তৈরি  করেছে। তারাই আমাকে শক্তি যুগিয়ে বুঝিয়েছে যে, আপানাকে বলিউডের  ফলো করতে হবে না, কলকাতার আর্ট হাউসও ফলো করতে হবে না, আপনি আপনার মতো করে ছবি বানান।        

বাংলানিউজ: ‘ডুব’-এর জন্য ইরফান খানকে আপনার প্রয়োজন ছিলো, আপনি তাকে পেয়েছেনও। তার মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অভিনেতাকে আপনি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন?

ফারুকী: আই থিংক সো। নিজের ছবি নিয়ে বলা মুশকিল। কিন্তু আমরা যদি ক্রিটিক্যাল রিভিউগুলো দেখি…। সেগুলোতে ইরফান খান ও তিশার অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এবং তারা বলেছে যে, এই ছবিতে অনেক কথা বলা হয় কোনো কথা না বলে। তারা বলেছে ইরফান ওয়াজ ম্যাগনেটিক, কেউ বলেছে মেসমেরাইজিং। তিশার ক্ষেত্রেও বলেছে।

বাংলানিউজ: আপনি বলেছেন যে, তিশাকে ছবিতে কাস্ট করে আপনি নির্ভার থাকেন। ধরলাম এটা আপনার অ্যাডভান্ডেজ। কিন্তু বউকে নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু ডিসঅ্যাডভান্টেজ-ও থাকার কথা…!
ফারুকী: ফ্র্যাংকলি বলবো, তিশাকে নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ডিসঅ্যাডভান্টেজ এখনও পাই নাই। যারা আমাকে চেনে তারা জানে যে, সত্য বলার ক্ষেত্রে আমি স্বামী-স্ত্রী কারোর দিকে তাকাই না। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের ডিসঅ্যাডভান্টেজ থাকতে পারে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিশা অ্যামাজিং। এর কারণটা হচ্ছে, সিনসিবল, আপনি খালি ভাবেন…বাংলাদেশের একজন অভিনেত্রী, একই সঙ্গে এতো জনপ্রিয়, পৃথিবীর সেরা সেরা ক্রিটিকরা তিশার অভিনয়ে মুগ্ধ, এটা এচিভ করা বাংলাদেশি অভিনেত্রী হিসেবে বিরল।   মানে ওই ধরনের টপ ক্রিটিকদের ক্রমাগত প্রশংসা পাওয়া, সেই ‘থার্ড পারসন…’ থেকে শুরু করে। ওই ছবিতে তার অভিনয়কে ভ্যারাইটি বলেছিলো, ক্যারিয়ার মেকিং রোল। ‘টেলিভিশন’-এও প্রশংসা পেয়েছে। এটা খুব সহজ খেলা না…

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীবাংলানিউজ: প্রায়ই বলেন যে, শুটিংয়ে আপনি খুব নিষ্ঠুর…এটা কোন অর্থে?
ফারুকী: নিষ্ঠুর এই অর্থে যে, আমি যা চাই, এর বাইরে একটি পাতাও নড়তে পারবে না। যদি আমার অলক্ষ্যে বাতাস এসে একটি ছায়া নাড়িয়ে দেয়, আমি এটি গ্রহণ করবো তখনই যখন আমার কাছে ছায়া নড়াটা ভালো লাগবে…। তার মানে ভালো লাগাটা আমার নির্বাচন করতে হবে। আমার নির্বাচনের বাইরে কিছু যেতে পারবে না।     

বাংলানিউজ: শুটিংয়ে আপনি নাকি মেজাজ হারিয়ে ফেলেন? গালমন্দও করেন?
ফারুকী: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রচুর মেজাজ হারাতাম, খুব বাজে। এক সময় গালমন্দ করতাম। আমার ধারনা এটা শুটিং ইউনিটের সকলেরই হয়। কিন্তু এখন আমি অনেক পরিবর্তিত একজন মানুষ।        

বাংলানিউজ: কবে থেকে?
ফারুকী: আমি সন তারিখ জানিনা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে কিছু স্থিতি আসে। এই বিয়ে, বিয়ের পরবর্তী জীবন, আমার মায়ের বিদায়, জীবনটাকেও আরেকটু গভীরভাবে চেনা, এগুলো একধরনের স্থিতি দিয়েছে। আর শুটিং ইউনিটের যে উত্তেজনা এটা পৃথিবীর বেশির ভাগ পরিচালকেরই থাকে। কিছুই করার নাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমার মধ্যে সেটা কমে আসছে…বুড়া হয়ে যাইতেছি মনে হয় (হাসি)।       

 

বাংলানিউজ: ‘ডুব’ নিয়ে আপনি এক ধরনের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এটা কী হুমায়ুন আহমেদের নাম জড়িয়েছে বলে? কী মনে হয়?
ফারুকী: এই ছবিটার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছে। ছবিটা আটকানোর জন্য দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলবো না। তবে যা হয়েছে তা ন্যাক্কারজনক। জীবন আমাকে খুব স্থিত ধী হতে শিখিয়েছে, ক্ষমাশীল হতে শিখিয়েছে, ভুলে যেতে শিখিয়েছে।      


বাংলানিউজ: আপনার ছবিতে হুমায়ুন আহমেদের জীবনের ঘটনা/ছায়া থাক বা না থাক। এ নিয়ে তার পরিবার কিংবা ভক্তদের আপত্তি উঠতে পারে, এটা স্বাভাবিক। ধরা যাক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর জীবনের গোপন বা অল্প জানা কোনো ঘটনা নিয়ে, যেটা আপনি বা আপনার পরিবার অনুমোদন দেন না, এমন বিষয় নিয়ে কোনো নির্মাতা ফিকশন বানালে কীভাবে দেখবেন?    
ফারুকী: এটার উত্তর আগেও দিয়েছি। এ নিয়ে লিখেছিও। এখানে আরেকটু বিশ্লেষণ করি। আমি একজন মানুষ। আমার সম্পর্কে একেকজনের একেক ধারনা না? কেউ বলে ভালো কেউ বলে খারাপ। কেউ প্রশংসা করে, কেউ গালি দেয়। এই বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমার আছে? তাহলে আমার নামোল্লেখ না করে কে কী বানাচ্ছে, কী বলবার আছে আমার? বলে রাখি, আমার মতো সাজ দিয়ে একুশে টেলিভিশনে একটি প্যারোডি অনুষ্ঠান বানিয়েছিলো, আমাকে গালিগালাজ করে। আমি জানতাম অনুষ্ঠানটা যাবে, আমি চেষ্টা করতে পারতাম ওটা আটকাতে। আমি সেটা করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। হুমায়ুন আহমেদ আমার প্রিয় লেখক, উনার জীবদ্দশায় কতো মানুষ তাকে গালি দিয়েছে, উনি কি প্রয়োজন বোধ করেছেন গালি বন্ধ করার? এভাবে বন্ধ করা যায়? এন্ড অব দ্য ডে এটা একটা গল্প। আর হুমায়ুন আহমেদ এবং বায়োপিক বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা লেখা লিখেছি। ওটা পড়ে নিলে আমার বক্তব্য পাওয়া যাবে।

বাংলানিউজ: ‘ডুব’-এর পর আপনি ট্রিলজি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। এর কী বিশেষ উদ্দেশ্য আছে?
ফারুকী: বলা হয়, পৃথিবী এগিয়েছে জ্ঞানে-কর্মে-শিক্ষা-দীক্ষায়। আসলে হিউম্যান ভ্যালুসই আগায় নাই। আগের দিনে একজন মানুষকে ঘৃণা করা হতো তার খারাপ কাজের কারণে। অর্থাৎ তার কর্মের জন্য তাকে ভালো বা মন্দ বলতাম। আর এখন, কর্মের প্রয়োজন নাই। তুমি কে? তোমার পরিচয়ই তোমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ এক আজব দুনিয়া বানিয়েছি আমরা। এই আজব দুনিয়াকে নিয়ে আমার তিনটি ছবি হবে। এর প্রথমটি ‘শনিবার বিকেল’, দ্বিতীয়টি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ আর তৃতীয়টি রোহিঙ্গদের নিয়ে, এখনও নাম ঠিক করতে পারিনি।

বাংলানিউজ: খুব বেশি যন্ত্রণা দিলে আপনি স্ক্রিপ্ট লেখেন, তারপর ছবি বানানো শুরু করেন। তেমনই একটি স্ক্রিপ্ট হয়তো করেছিলেন বেশ আগে। শুনেছি রকস্টার জেমসকে নিয়ে আপনি ছবি বানাতে চেয়েছিলেন? তার সঙ্গে একসময় আড্ডাও দিতেন…
ফারুকী: হ্যা পরিকল্পনা ছিলো। জেমস ভাইকে নিয়ে ৪০ মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘লীলা’। অনেকদিন জেমস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় না। মাঝখানে এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিলো, আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস?’ জেমস ভাইকে আমরা খুব ভালোবাসি। জেমস ভাই, বাচ্চু ভাই, মাকসুদ ভাই, আজম ভাই— আমরা তো রক জেনারেশন। ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’র সময় জেমস ভাইয়ের কাছে গিয়ে শর্ট ফিল্ম বানানোর কথা তুললাম। তিনি বলেছিলেন কোনো অসুবিধা নাই, চলে আয়। এরপর ছবিটবি ভুলে আমরা দিনরাত আড্ডা দিতে লাগলাম…এভাবে চললো এক বছর। জানিনা আর কখনো ‘লীলা’ হবে কি-না…
    
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৭
এসও

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।