ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

প্রথমবার জেল ভেঙেছিলেন, পরেরবার বেঁচেছিলেন ভাগ্যক্রমে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৯
প্রথমবার জেল ভেঙেছিলেন, পরেরবার বেঁচেছিলেন ভাগ্যক্রমে

মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি কিশোর। সেই কৈশোরেই অসীম সাহসে মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে নেমে যান। যুদ্ধ চলাকালে দুইবার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। প্রথমবার পালিয়েছিলেন জেল ভেঙে। পরেরবার ধরা পড়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানিরা মেরে ফেললেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনিসহ হাতেগোনা কয়েকজন। বিজয়ের পর রণাঙ্গনে দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য তাকে এক হাজার টাকা পুরস্কারও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। যিনি এদেশের মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছেন ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘সেই রেল লাইনের ধারে’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মতো দেশাত্মবোধক গানের সুরে।

৬২ বছর বয়সী বুলবুল মঙ্গলবার (২২ জানুয়ারি) চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো নিয়ে প্রায় এক যুগ আগে ঢাকার একটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছিলেন বুলবুল। সেই বীরত্বগাঁথায় বুলবুল অবিস্মরণীয় থাকবেন বাঙালি জাতির হৃদয়ে।

ওই সাক্ষাৎকারে বুলবুল জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় কয়েকটি গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। পরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরে। এই যুদ্ধের সময় দুইবার হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বুলবুল।

স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কৈশোর থেকেই গিটার বাজাতাম। যুদ্ধ যখন শুরু হলো- আমার বড় ভাই ইফতেখারউদ্দিন আহমেদ যোগ দেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মায়ার নেতৃত্বাধীন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দল ক্র্যাক প্লাটুনে। এই বাহিনী ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ চালাতো। একদিন আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে গ্রেনেড নিয়ে বন্ধু ফুয়াদকে সঙ্গে করে নিউ মার্কেটে গেরিলা অপারেশন চালাই। এর মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু করি আমি। ’

জুনে বুলবুল যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরে। ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নোয়াখালীর কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার। একদিন অভিযানের জন্য কমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়ে যান বুলবুল।

তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ওই রোডে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকার গুনে আসা। আমরা ২৫টা বাংকার গুনলাম। যখন গ্রুপ কমান্ডার সজিবের কাছে রিপোর্ট দিতে যাচ্ছিলাম, তখন মানিক, খোকা, মাহবুব ও আমি ধরা পড়ে যাই। ’

গ্রেফতারের পর বুলবুলদের সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বুলবুল ও তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে যাওয়া হয় সেনানিবাসের ফায়ারিং স্কোয়াডে, ‘আমরা ভাবছিলাম, আমাদের জীবন শেষ হয়ে এসেছে, সেজন্য সবাই জোরে জোরে কালেমা পড়তে থাকলাম। কিন্তু খানিকবাদেই ওরা কেন যেন সিদ্ধান্ত বদলালো এবং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ সেলে নিয়ে গেলো, হয়তো দুই নম্বর সেক্টরের তথ্য বের করার জন্য। পরে আমাদের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ’

কারাগারে বুলবুল আরও ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধার দেখা পান। সেখানে তাদের সঙ্গে জেল ভাঙার ছক কষেন কিশোর এ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু শহীদ নজরুল ইসলাম এক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করেন বুলবুলকে। তার ভাষ্যে, ‘নজরুল ভাই মনে করতেন বিজয় আমাদের দ্বারপ্রান্তে। মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের উদ্ধার করবেন। আমাদের পালানো উচিত নয়। কিন্তু ২৭ রমজানে (১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে) পাকিস্তানের একদল সেনা দুই নম্বর সেক্টরের আমরা চারজন ছাড়া বাকিদের নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। তারা ভেবেছিল আমাদের এই চারজনের কাছ থেকে দুই নম্বর সেক্টর সম্পর্কে আরও তথ্য বের করতে পারবে। পরের দিনই আমরা জেল ভেঙে পালিয়ে যাই। ’

সেখান থেকে বুলবুল নৌকায় করে ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু যখন বাড়ি ফেরেন, তখন আবার গ্রেফতার হন। বুলবুলকে এবার নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে। তিনি বলছিলেন, ‘সেনানিবাসে গ্রেফতার অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমাকেও নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। এতো বর্বরোচিত নির্যাতন হতো, আমি বেহুঁশ হয়ে যেতাম। একবার হুঁশ ফেরার পর দেখি একটি ছোট্ট অন্ধকার ঘরে বন্দি। সেটা ছিল রমনা থানা। ’

বুলবুল বলছিলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি ট্রাক এসে কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যেতো। তারপর তাদের মেরে ফেলা হতো। প্রতিদিনই ১৫ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যেতো এবং তাদের আর দেখা যেতো না। নিজেদের সাহস যোগাতে আমরা গণসংগীত গাইতাম। যতদিনে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মিত্রবাহিনী বিমান হামলা শুরু করলো, আমরা অল্প ক’জন বেঁচেছিলাম। বিজয়ের পর আমরা মুক্তি লাভ করি। ’

মুক্তি পেলেও সেই নির্মম নির্যাতনের ক্ষত বুলবুলকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল বহুদিন। তবে মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য কিশোর যোদ্ধা বুলবুলকে তখন এক হাজার টাকা পুরস্কার দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার চিকিৎসার সব দায়িত্বও নেয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার।

মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অনস্বীকার্য প্রভাব ফেলে বুলবুলের সংগীতজীবনে। তার ভাষ্যে, ‘স্বাধীনতার পর আমি বিটিভির জন্য দেশাত্মবোধক গান বানাতে থাকি। এই গানগুলো গাইতেন সাবিনা ইয়াসমিন। এর মধ্যে ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’ উল্লেখযোগ্য।

মৃত্যুর আগে গত ২ জানুয়ারি বুলবুল তার সবশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম। ’ তার এই ক্যাপশনের শেষেই ছিল প্রিয় দেশের লাল-সবুজ পতাকা, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য কৈশোরেই তিনি লড়েছিলেন রণাঙ্গনে।

স্বাধীনতা উপহার দেওয়ার পর এই দেশের সংগীতাঙ্গনকে ঋদ্ধ করতে যিনি সাধনা করে গেছেন জীবনভর, তাকে কি ভুলে যেতে পারে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৯
এইচএ/

** বুধবার মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন হবে বুলবুলের
** ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও...’
** আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।