এর মধ্যে আড়াই হাজারের বেশি নাটকের সুর-সংগীত (আবহসংগীতসহ), চার শতাধিক ধারাবাহিক, শতাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য-থিম সং এবং ২৫-৩০টির মতো সিনেমার গান তৈরি করেছেন গুণী এই সংগীত পরিচালক। এছাড়া তিন দশকের বেশি সময় ধরে মানুষের মুখে মুখে ফেরা ইত্যাদির থিম সংটিও তারই তৈরি করা।
সদ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া, বর্তমান ব্যস্ততা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
বাংলানিউজ: প্রয়াত সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’ সিনেমার সবগুলো গান তো আপনি তৈরি করছেন এবং সম্প্রতি এর অসমাপ্ত কাজের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। এর গানগুলো সম্পর্কে জানতে-
ফরিদ আহমেদ: আসলে টুটুল ভাই প্রয়াত হওয়ার পর সিনেমাটি কাজ আটকে ছিল অনেকদিন। এরপর সিনেমাটির অসমাপ্ত কাজ করেন তার স্ত্রী মোবাশ্বেরা খানম। এ সিনেমার সবগুলো গানই আমি করেছি। অবশ্য কাজটি করেছি অনেক আগেই। কিন্তু কিছু টুকটাক কাজ বাকি ছিল। সম্প্রতি সেই কাজগুলো ভারত থেকে সম্পন্ন করে এলাম।
বাংলানিউজ: কী কাজ বাকি ছিল, যেটি করতে দেশের বাইরে যেতে হলো?
ফরিদ আহমেদ: সত্যি কথা বলতে আমাদের এখানে এখনো পর্যন্ত সব ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রশিল্পী তৈরি হয়নি। সিনেমার গল্প অনুযায়ী গানগুলোতে পাখওয়াজ, খোল, সারেঙ্গী, সরোদ, এসরাজ, বেহালা, সেতার, বাঁশি, তবলা প্রভৃতি যন্ত্র ব্যবহার করা লাগে। কিন্তু পাখওয়াজ, খোল, সরোদ, এসরাজ প্রভৃতি যন্ত্রের শিল্পী আমাদের এখানে নেই বললেই চলে। এ যন্ত্রগুলো যথাযথ ব্যবহারের জন্য আমাকে দেশের বাইরে যেতে হলো। সিনেমাটিতে থাকছে ৪টি রবীন্দ্রসংগীত ও একটি গণসংগীত।
বাংলানিউজ: আপনার এখনকার ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাই-
ফরিদ আহমেদ: মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৫টি গান তৈরি করেছি। গানগুলো লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান (১টি) ও সুমন সরদার (৪টি)। এছাড়া আরও নতুন দুটি দেশাত্মবোধক গান তৈরি করছি। এর মধ্যে একটি দ্বৈত ও একটি একক। একটি একক গানের পাশাপাশি দ্বৈতগানটি মুহিন খানের সঙ্গে গাইছেন চম্পা বনিক।
বাংলানিউজ: চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্ব সুন্দরী’ সিনেমাতেও তো আপনি গান তৈরি করেছেন। এতে কারা গেয়েছেন আপনার সুর-সংগীতে এবং কাজটি কেমন হয়েছে?
ফরিদ আহমেদ: সিনেমাটির জন্য একটি দেশাত্মবোধক গান তৈরি করেছি। গানটি দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমীন ও পুলক অধিকারী। সবুজ-শ্যামলে ভরা এ দেশ আমার/লুটে নিয়েছিল হায়েনারা/সে দেশ রক্ষায় রুখে দাঁড়িয়ে/জীবন বাজি রেখেছিল যারা- এমন কথার গানটির সুর-সংগীতায়োজন করে বেশ ভালো লেগেছে।
বাংলানিউজ: ‘তুমি রবে নীরবে’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন। এ প্রাপ্তিতে ভালোলাগার কথা শুনতে চাই-
ফরিদ আহমেদ: অনেক ভালোলাগা আছে নিঃসন্দেহে। ভালো কাজের স্বীকৃতি পেলে কার না ভালো লাগে! দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে আমি ২৫-৩০টি মতো সিনেমায় কাজ করেছি। ২০০০ সাল থেকে সিনেমায় চরম অশ্লীলতা বিস্তার করেছিল। সে সময় অনেক সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু কাজ করিনি। অবশ্য সে সময় একটি কাজ আমাকে চাপ দিয়ে করানো হয়েছিল। সেই কষ্টে আমি ঘোষণা দিয়েই কাজ করিনি।
এরপর সিনেমার অবস্থা ভালো দিকে ফেরার পর আবার কাজ শুরু করি। ভালো কাজের তাড়নায় আমার কিছু ত্যাগ রয়েছে। তার ফলাফল দেরিতে হলেও পেয়েছি। সেটাই আমার ভালোলাগা, বড় প্রাপ্তি। বলে রাখি, ‘তুমি রবে নীরবে’ সিনেমায় তিনটি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হয়েছে। সবগুলো গানের সংগীত পরিচালনা আমারই করা।
বাংলানিউজ: উপমহাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সংগীত ক্যারিয়ারে প্রথম এবং একমাত্র জনপ্রিয় মৌলিক গানের কারিগর আপনি। বন্যার কণ্ঠে ‘গহীনে শব্দ’ সিনেমার সেই গান তৈরির গল্পটা বলবেন-
ফরিদ আহমেদ: সিনেমাটির পরিচালক প্রয়াত খাদিল মাহমুদ মিঠু। অনেক গুণী একজন নির্মাতা, অকালেই ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বন্যা আপার কণ্ঠকে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি চেয়েছিলেন ‘গহীনে শব্দ’ সিনেমায় বন্যা আপার কণ্ঠটা ব্যবহৃত হোক। আর এ সিনেমার টাইটেল গান ও আবহসংগীত পরিচালনার দায়িত্বটি দেন আমাকে। বন্যা আপার কণ্ঠকে ষোলআনা মাথায় রেখেই সুর-সংগীত করি ‘তুমি আমার জীবনের গহীনে আসো/পারো যদি একবার আমায় ভালোবাসো’ শীর্ষক গানটির।
সিনেমার গল্পের সঙ্গে গানটি ছিল যথার্থ। তাই গানটি শ্রোতারাও দারুণভাবে গ্রহণ করেন। এ গানের জন্য মানুষের অনেক ভালোবাসা-প্রশংসা পেয়েছি। এ গানটি আমার সংগীত ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটি কাজ। আরেকটি বিশেষ ভালোলাগা হলো- বন্যা আপার ক্যারিয়ারে একমাত্র এই জনপ্রিয় গানটি আমার করা।
বাংলানিউজ: আড়াই হাজারের বেশি নাটক, চার শতাধিক ধারাবাহিক এবং জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’সহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি ও টিভি অনুষ্ঠানের থিম সং আপনি তৈরি করেছেন। অনেকগুলো কাজ দারুণ প্রশংসিতও হয়েছে। কিন্তু কাজগুলো যে আপনার তা অনেকেই জানেন না। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ কাজ করে কী?
ফরিদ আহমেদ: আমি আমার কাজটা করি। পেছনের মানুষ হিসেবে এ ব্যাপারটি নিয়ে আমি আক্ষেপ করতে পারি না। বলতে পারেন, এটা সিস্টেমের অংশ বিশেষ। আমি আমার কাজটি করে যেতে চাই। তবে আমার সংগীত ক্যারিয়ারের বড় একটা আক্ষেপ রয়েছে, সেটি আর পূরণ হওয়ার নয়।
বাংলানিউজ: কী সেই আক্ষেপ, শুনতে চাই-
ফরিদ আহমেদ: রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ’সহ অনেক গুণী শিল্পীর জন্য গান তৈরি করেছি। কিন্তু শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র জন্য গান তৈরি করতে পারলাম না। এই আক্ষেপটা আমার সারাজীবনই থেকে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২০
ওএফবি