ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

সত্যজিৎ রায় ও বাংলাদেশ

মুহাম্মাদ আলতামিশ নাবিল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
সত্যজিৎ রায় ও বাংলাদেশ ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়

ভূতের রাজা দিলো বর, জবর জবর তিন বর! শৈশবে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে ভারতের ডিডিবাংলা চ্যানেলে দেখা গুপী বাঘা সিরিজের ছবিগুলোতে ভূতের রাজার দেওয়া বরের ফলে গুপী বাঘার দেখানো ম্যাজিকে মন্ত্রমুগ্ধ হতাম। আস্তে আস্তে যখন বড় হলাম তখন বুঝতে শুরু করলাম, আসল ম্যাজিশিয়ান আর কেউ নয় সেই ছবিগুলোর নির্মাতা স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।

 

গুপী-বাঘা ভূতের রাজার দেওয়া বর’গুলো দিয়ে যেমন মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারতো, একজন চলচ্চিত্রকারের নিজেরও তেমন দর্শকদের মোহাবিষ্ট করার ক্ষমতা আছে। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে সেই মোহ তৈরির বিষয়টা অনেক বেশি তড়িৎ। ইতিহাস, সাহিত্য, রম্য, রোমা, ভ্রমণ, ফ্যান্টাসি…কী নেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলোতে। কিন্তু এইচডি, ব্লুরের ফাঁক গলে সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে কতদূর পৌঁছেছে তা নিয়ে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে।  

শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবসে এই লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের যোগসূত্রগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা থাকছে-

বাংলাদেশের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কের দিকগুলোও কম নয়। রায় বংশের আগের প্রজন্মগুলোর সম্পর্কে জানা যায়, তাদের এক পূর্বপুরুষ যার নাম শ্রী রামসুন্দর দেও (দেব) যিনি ছিলেন নদীয়া জেলার চাকদহ গ্রামের বাসিন্দা। ভাগ্যচক্রে তিনি পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশের) শেরপুরে আসেন। শেরপুরের জমিদারের বাড়িতে বসে তার সাক্ষাৎ হয় যশোদলের জমিদারের সঙ্গে; যার নাম রাজা গুণীচন্দ্র। এই সাক্ষাৎই তার শাপে বর হয়। রামসুন্দরের বুদ্ধিমত্তা-সৌন্দর্য রাজা গুণীচন্দ্রকে আকৃষ্ট করে এবং তাকে যশোদলে নিয়ে রাজার জামাই বানান। এরপর তার কোনো এক বংশধর সেখান থেকে সরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে মসুয়া গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন; যেটি বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার অন্তর্গত।  

সত্যজিতের দাদা (পিতামহ) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায় দুজনেরই জন্ম হয়েছিল এখানে। উপেন্দ্রকিশোরের কাকা হরি কিশোরও ছিলেন মসূয়ার বড় জমিদার। কিশোরগঞ্জে গেলে আজও সেই জীর্ণ ভিটাটি দেখতে পাওয়া যায়, তবে ইতিহাস সংরক্ষণের নিমিত্তে সেটির সংস্কারকার্য অবশ্য প্রয়োজন।
 ‘অশনি সংকেত’-এর দৃশ্যে ববিতা

বাংলাদেশের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ বাংলাদেশি অভিনেত্রী ববিতাকে চলচ্চিত্র ‘অশনি সংকেত’-এ অভিনয়ের সুযোগ ঘটানো; যেটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ লাগে যা ইতিহাসে তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। জাপান প্রতিবেশী দেশ বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) দখল করার পর শুরু হয় এই দুর্ভিক্ষ। ওই সময় বার্মা ছিল এ অঞ্চলের চাল আমদানির বড় উৎস। উৎসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও ভারতবর্ষের তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করায় এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই মন্বন্তরে বাংলাজুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ কীভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল- তারই বর্ণনা রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘অশনি সংকেত’-এ। চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের চিত্রনায়িকা ববিতা।
 
নানা সময়ে বাংলাদেশে প্রকাশিত ববিতার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তার ছবিটিতে কাজ করার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৭৩ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অশনি সংকেত’ সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার পায়। উৎসবটিতে ছবিটির পরিচালক সত্যজিৎ রায় এবং তার সঙ্গে ছবির শিল্পীরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে জার্মান তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ছবির নায়িকা বাংলাদেশি হওয়ায় ববিতাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল বিমানবন্দরে। তখন ববিতা একেবারে কেঁদেকেটে অস্থির! সত্যজিৎ বলেন, ‘আমার নায়িকা যেতে পারবে না এটা কোনোভাবেই হয় না। ’ অবশেষে আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে দেশটিতে ঢোকার অনুমতি পান ববিতা। সত্যিকারের ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ একেই বলে।


ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়, সংগীত শিল্পী শ্যামল মিত্র, স্বপ্না রায়, জয়ন্ত দাস, সুমিত্রা মুখার্জি, আপেল মাহমুদ, বরুণ বক্সী, অমল মুখার্জী, শেখ জামাল (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ও শেষবারের মতো আসেন সত্যজিৎ রায় যার উপলক্ষ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস (বর্তমান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) স্মরণে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়া। সেদিনের পল্টন ময়দানে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা ভাষণে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ভাষণের পুরোটা সময় তিনি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তিনি আরও জানান তিনি এদেশে বাপ-দাদার ভিটায় নিজের পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে একবার এসেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন নতুন একটি ইতিহাসের দরজা খুলে যাওয়া হিসেবে।

ভাষণের এক পর্যায়ে সত্যজিৎ রায় প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি আবার আসবেন এই দেশে। মিশবেন দেশের জনগণের সঙ্গে। ভাষণের শেষে সত্যজিৎ রায় জয়বাংলা বলে সমাপ্তি করেন। তবে নানা পরিস্থিতিতে সে ইচ্ছে আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। সেই সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ যাত্রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন তিনি। একই ফ্রেমবন্দী হয়েছিলেন তারা।

সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায় অর্জন করেন একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারটি (অস্কার)। যদিও শরীর অসুস্থ থাকায় তিনি পুরস্কার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মৃত্যুশয্যায় ধারণকৃত তার অস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ধারণ করে পরবর্তীকালে অস্কার অনুষ্ঠানে দেখানো হয় যেটি ঘোষণা করেছিলেন অড্রে হেপবার্ন।  

অস্কার পুরস্কার প্রাপ্তির মাত্র তেইশ দিন পর ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়, সবার প্রিয় মানিক দা পার্থিব জীবন থেকে চির বিদায় নেন। তার মৃত্যুর পর কলকাতার জীবনযাত্রা থেমে পড়ে। হাজার হাজার লোক শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার বাড়িতে আসেন। মৃত্যুর এতবছর পরও তিনি যেন আগের মতই জীবন্ত, সকল চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের মনে, বাঙালীর মনে, বাংলাদেশিদের মনে... আজও।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।