ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

সুস্থতার কক্ষে একাকী দিন কাটছে ‘বনমানুষ’টির

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২২
সুস্থতার কক্ষে একাকী দিন কাটছে ‘বনমানুষ’টির সুস্থতার কক্ষে একাকী বসে আছে উল্লুকটি। ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: ‘বনমানুষ’ শব্দটাই বলে দেয় বনে বাস করা প্রাণি সে। মানুষরূপী যে প্রাণি বনে বাস করে সে-ই বনমানুষ।

গাছে গাছে ডালে ডালে দিন কাটে তার। তবে সে কখনোই মাটিতে নামে না। গাছে গাছেই তার জীবন। এরা উঁচু গাছের মাথায় থাকতে বেশি পছন্দ করে।

‘উল্লুক’ (Hoolock gibbon) প্রাণিটিকেই ‘বনমানুষ’ হিসেবে নামকরণ করেছেন বন্যপ্রাণি গবেষকরা।

সম্প্রতি একটি শিশু বনমানুষকে দেখা গেলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্যপ্রাণি রেসকিউ সেণ্টারে। সেখানেই একটি সুস্থতার কক্ষে নিঃসঙ্গ-একাকী জীবনযাপন করছে বেচারা। কক্ষবন্দী হয়ে একাকী দিন কাটছে বনমানুষটির।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আওতাধীন শ্রীমঙ্গল বন্যপ্রাণি রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. শাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এই উল্লুকটি চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করে কুমিল্লা সামাজিক বনবিভাগ। পরে তাকে জানকিছড়া রেসকিউ সেণ্টারে পাঠানো হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩ মাস। তার উপযোগী বনের খাবারই তাকে খাওয়ানো হচ্ছে। ডুমুর, কচি পাতা- এগুলো তাকে খাওয়ানো চেষ্টা করছি। মধ্যে দুধ ছাড়া অন্যকিছু খাচ্ছিলো না সে। এখন বনের ওই ফলগুলোই খাচ্ছে। আর নরমালি কলা বেশি খাচ্ছে সে। আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে সে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও খোঁজখবর রাখছেন।

বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনাক্রমে উল্লুকটিকে বনে অবমুক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানায়, উল্লুক মহাবিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী। পুরুষ উল্লুকের গায়ের রং কালো এবং স্ত্রী উল্লুকের গায়ের রং হলদে-ধূসর। বাচ্চাগুলোর লোম ধূসর-সাদা, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীগুলো হলদে-ধূসর রঙ ধারণ করে। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ বনে এদের দেখা যায়। এদের জীবনকাল ১৫ থেকে ১৭ বছর।

বন্যপ্রাণি গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, উল্লুক হচ্ছে সামাজিক দলবদ্ধ প্রাণি। এদের বনমানুষ বলা হয়। এরা পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং একই পরিবারের প্রাণিরা একসঙ্গে থাকে। বাবা, মা, সন্তান, আগের সন্তান, নতুন সন্তান একসঙ্গে থাকে। যেগুলো একদম অ্যাডাল্ট (প্রাপ্তবয়স্ক) হয়ে যায়, তারা আবার আলাদা করে দল বানালেও বানাতে পারে। এখন একটা উল্লুককে বনে ছেড়ে দেয়া হলে বেঁচে থাকাটা তার জন্য খুব ডিফিক্যাল্ট (জটিল) হবে। অন্য যেকোনো প্রাণিকে বনে ছাড়া যায়, কিন্তু উল্লুককে একা বনে ছাড়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হয়তো সে বেঁচে থাকতে পারবে, কিন্তু কোনো দল তাকে গ্রহণ করতে চাইবে না সহজে।

তিনি বলেন, ‘এই উল্লুকটি যদি নারী হয়, তাহলে অন্য উল্লুক, যারা অ্যাডাল্ট হয়ে গেছে এবং নিজের পরিবার করা দরকার, তারা হয়তো এই একা ছেড়ে দেয়া উল্লুকটিকে নিয়ে একটা দল গঠন করতে পারে। ’

প্রাণি অবমুক্তির প্রসঙ্গে এ বন্যপ্রাণি গবেষক বলেন, “আমরা অনেকেই এক এলাকার প্রাণি এনে আরেক এলাকায় ছেড়ে দেই। এটা যেহেতু কুমিল্লা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, বন বিভাগের উচিৎ ছিল আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে পাচারকারীদের কাছ থেকে প্রাণিটির যাবতীয় তথ্য উদঘাটন করা যে, এটা আসলে কোন বনের প্রাণি? এই প্রাণীটাকে তারা আসলে কোথা থেকে ধরেছিল। পাচারকারীদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা জানা উচিৎ ছিল- এটা কোন ফরেস্টের প্রাণি। তাহলে এই প্রাণিটাকে সেই ফরেস্টে ছাড়া হলে সে তার পরিবারকে তার মাকে হয়তো ফিরে পেতে পারতো। তখন প্রকৃতিতে তার সারভাইব (টিকে থাকা) করাটা আরও সহজ হতো। উল্লুকের মতো পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন প্রাণির বিষয়ে আরও সচেতন, আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। ”

সামাজিক বিচরণবৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আদনান আজাদ জানান, বাঘ-সাপ হচ্ছে সলিটরি এনিমেল (নির্জন প্রাণি), কিন্তু উল্লুক পরিবার আবদ্ধ প্রাণি। তাকে আপনি কখনোই একা একা গাছে বিচরণ করতে দেখবেন না। তারা সবসময়ই দলগত থাকে। সবসময়ই পরিবারে জোটবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। হনুমান, বানর প্রভৃতি প্রাণিরা যেমন নিজের সন্তানসহ অন্য ছেলে-মেয়ে, খালা-খালু, চাচা-চাচী এগুলো নিয়ে দল বড় করে। উল্লুক কিন্তু কখনোই এমনটা করে না। ওরা একেবারে নিজস্ব দলে থাকে। অর্থাৎ বাবা, মা আর সন্তান। এই হচ্ছে উল্লুকের সামাজিক বিচরণবৈশিষ্ট্য।  

এই মুহূর্তে জানকিছড়ার রেসকিউ সেণ্টারে থাকা ওই উল্লুককে এখনই বনে ছাড়া উচিৎ হবে না। অন্তত আরও ৫/৬ মাস পরে শারীরিক সুস্থতা, প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণের স্বাভাবিকতা ইত্যাদি বিষয় পজেটিভ হলে তবেই তাকে বনে ছাড়া যেতে পারে বলে জানান এই বন্যপ্রাণি গবেষক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০২২
বিবিবি/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।