মৌলভীবাজার: ছেলেবেলার কথা তো মনে আছে নিশ্চয়ই! দুষ্টমির চঞ্চল চোখে ঘুম না এলে মা তার সন্তানকে বলতেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ঘুমাও। নয়তো শিয়াল ডাকবো।
অনেকেই অতীত স্মৃতিচারণে ‘শিয়াল’ শব্দটি আজও জীবন্ত। ওরা চা বাগানের বিশাল জনপদে আজও ‘হুক্কাহুয়া, হুক্কাহুয়া’ বলে ডেকে নিজের অবস্থান জানান দেয়।
বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে বিচরণকারী এই বিশেষ প্রজাতির বন্যপ্রাণীটি প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করে টিকে রয়েছে। বন, জঙ্গল, ঝোপঝাড়, মাটির নির্জন গর্তসহ তাদের লুকানোর জায়গার অভাব, খাদ্য সংকট, প্রজনন সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি নানান সমস্যায় তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
এর থেকেও বেদনার কথা, আজ ‘শিয়াল’ শব্দে হারিয়ে যায় দুই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে বাংলার বুকজুড়ে দুই প্রজাতির শিয়াল ঘুরে বেড়ালেও অধিকাংশ মানুষই তাকে চেনেন শুধুমাত্র ‘শিয়াল’ নামেই চিনে।
বনবিভাগের ‘সুফল’ প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত ‘ভাল্লুক এবং বন্য কুকুর সংরক্ষণ প্রকল্প’র গবেষণা সহকারী সুলতান আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, রাতের আঁধারে দুইটি প্রজাতির শিয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের শুধুমাত্র একটি নামেই চেনে। আর তা হলো ‘শিয়াল’। তাদের তো ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে এবং সে দুটো নামেই চিনে রাখা দরকার। পাতিশিয়ালের ইংরেজি নাম Golden jackal এবং বৈজ্ঞানিক নাম Canis aureus আর খেঁকশিয়ালের ইংরেজি নাম Bengal Fox এবং বৈজ্ঞানিক নাম Vulpes bengalensis।
পাতিশিয়াল প্রজাতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এরা আমাদের প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাই ধরা যাক। পাতিশিয়ালরা তাদের খাবারে ছোট প্রাণী যেমন ছোট মাংসের প্রাণী, পাখি, এবং পোকা খেয়ে এই খাদ্যশৃঙ্গলে প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যা একটি পরিস্থিতির বৈচিত্র্যমূলক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রণালি সমর্থন করে। এছাড়াও রয়েছে বাস্ততন্ত্রের সুস্থতা। অর্থাৎ পাতিশিয়ালরা মৃত্যুযোগ্য প্রাণী বা অসুস্থ প্রাণী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তুতন্ত্রের সুস্থ রাখে। এছাড়াও ফসলি জমির ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
যদিও এ প্রজাতি সামগ্রিকভাবে বিপদগ্রস্ত পর্যায়ে নেই। কিছু স্থানীয় আবাসস্থল ধ্বংস, বন উজাড়, মানব-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষ, এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকরণের জন্য এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফসলি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার এদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বলে জানান সুলতান।
খেঁকশিয়াল প্রজাতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ক্যানিডে পরিবারভূক্ত প্রাণীদের মধ্যে খেঁকশিয়ালই সবচেয়ে ছোট সদস্য। এরা খুব ধূর্ত, চঞ্চল ও দ্রুত বেগে দৌড়াতে সক্ষম। এরা ছোট ছোট প্রাণী শিকার করে জীবনধারন করে। ইঁদুর, ঘাসফড়িং, পাখি ও এর ডিম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি এরা বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে থাকে। কখনোবা এরা গলিত পচা মাংসও খায়। নিশাচর প্রাণী হিসেবে এরা দিনের বেলা ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ও ঘুমায় কিংবা বিশ্রাম নেয়। গোধূলিলগ্নে এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং শিকারের সন্ধানে বের হয়।
ছোট আকৃতির এই শিয়াল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খেঁকশিয়াল সর্বভূক প্রাণী হিসেবে ও পরিচিত অন্যান্য ছোটোখাটো প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। সরীসৃপ হিসেবে সাপ, কাঁকড়া, ঘাস, ফল, মাছ, পাখি, ডিম, পোকামাকড়সহ বহুবিধ প্রাণী এদের প্রধান খাবার। এরা ফসলি জমির ইঁদুর ও অনান্য পোকামাকড় খেয়ে ফসলের ক্ষতির হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করে।
শিকার, সড়ক দুর্ঘটনা, মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, আবাসস্থল ধ্বংস, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, কীটনাশকসের প্রভাবে এদের অস্তিত্ব প্রায় হুমকির মুখে। এরা আইইসিএন, বাংলাদেশের Vulnerable অর্থাৎ ‘সংকটাপন্ন’ তালিকাভুক্ত প্রাণী বলে জানান সুলতান আহমেদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৩
বিবিবি/এএটি