ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পাতিহাঁস দলের ‘প্যাক প্যাক’ ধ্বনি শোনার সুতীব্র বাসনা

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১২
পাতিহাঁস দলের ‘প্যাক প্যাক’ ধ্বনি শোনার সুতীব্র বাসনা

কাপাসিয়া (গাজীপুর) থেকে ফিরে: ‘বয়স ও অনুভূতি শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায় একজন মানুষের সৌন্দর্যচেতনাও’- এই উপলব্ধিটি গত কয়েক বছর ধরে প্রবলভাবে আমার ওপর ভর করলেও সম্প্রতি সেটি আরো অর্থবহভাবে ধরা দিয়েছে আমার মানসপটে।  

গাজীপুর আমার নিজের জেলা, এখানে জন্মগ্রহণ করেছি-বেড়ে উঠেছি এখানকার কাদামাটি-জল মেখেই।

জেলার শ্রীপুর উপজেলার শিমুলতলা গ্রাম। শাপলাবিল, ছোটনদী-খাল, লালমাটির টিলা, কাঁকড় সদৃশ্য কণা বিছানো মেঠোপথ, ঘন-গভীর গজারিবন ইত্যাদি গ্রামীণ জীবনের হাজারো অনুসঙ্গ বিরাজমান এই গ্রামে। একটু বড় হয়েই-কৈশোরে সাইকেলে চেপে দাপিয়ে বেড়িয়েছি শিমুলতলা গ্রাম ছাড়াও আশপাশের বহু গ্রাম। সোনাব, ধামলই, গলদাপাড়া, হয়দেবপুর, কাওরাইদ, নয়াপাড়া, বিধাই, আবদার, ভিটিপাড়া, গোলাঘাট-কত বিচিত্র নামের সব গ্রাম। সাইকেলে চেপে কখনো কখনো বেরিয়ে পড়েছি পার্শ্ববর্তী কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, গাজীপুর সদর, ভালুকা, গফরগাঁও, ত্রিশালসহ আরো অনেক উপজেলায়। শৈশব থেকেই অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেম ছিল আমার মধ্যে।
04
পরবর্তীতে যখন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করলাম তখনও অক্ষুন্ন ছিল সেই প্রেম। নিজের মোটরসাইকেল না থাকলেও সহকর্মীদের পেছনে উঠে, কখনো কখনো তেলখরচ দিয়েও বেরিয়ে পড়েছি প্রকৃতি সন্দর্শনে। এভাবেই গাজীপুর ও আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোর নয়নাভিরাম শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে আমার গভীর-আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তবে অদ্ভূতভাবেই প্রত্যক্ষ করতে থাকলাম-সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার দেখা চিরচেনা সেই প্রকৃতিও আমার কাছে ধরা দিতে শুরু করলো নতুনরূপে। বলা যায় নতুনভাবেই একে আবিষ্কার করতে আরম্ভ করলাম।

মাত্র দু’দিন আগের কথা (১৪ ভাদ্র ১৪১৯/২৯ আগস্ট ২০১২)। গাজীপুর-৪(কাপাসিয়া) সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমির প্রথম নির্বাচনী কর্মীসভা কাভার করতে ঢাকা থেকে সহকর্মী আলোকচিত্রী কাশেম হারুনকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিয়েছি।

যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে গাজীপুর চৌরাস্তা নেমে জেলা শহরের ওপর দিয়ে সহজ রাস্তায় যেতে ফন্দি আঁটলাম। জেলা শহর থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন গাজীপুর প্রতিনিধি একেএম রিপন আনসারী। বলা চলে তার পরামর্শেই এই নতুন পথ বাতলে গন্তব্যে পৌছানোর ফিকির। তখনও আমি জানি না কোন পথে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে অজ্ঞতাও আশীর্বাদ হয়ে যায়! এখানেও তাই ঘটলো। বাহন রিপন আনসারীর নিজস্ব প্রাইভেট কার। কোথাও বিলম্ব না করে এগুতে থাকলাম আমরা। শুরুতে খেয়াল না হলেও কিছু সময় পরেই বুঝতে পারলাম আমরা যাচ্ছি আমার অসম্ভবপ্রিয় একটি পথ ধরে।
03
গাজীপুর জেলা শহর থেকে কিছুদূর পূর্বদিকে এগুতেই হাড়িনাল গ্রাম। সেখান থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে একটি পাকা রাস্তা চলে গেছে। কতদূর এগিয়েই হানকাটা ব্রিজ। স্বভাবকবি গোবিন্দ দাসের স্মৃতিধন্য প্রিয়নদী চিলাইয়ের ওপর নির্মিত ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়েই রাস্তার বামে ‘বর্ষাবিলাস’, কিংশুক এনজিওর মালিকানাধীন বিলে ভাসমান রেস্তোরাঁ। গাজীপুর জেলা শহরের বাসিন্দারা একটু নির্মল নিশ্বাস নিতে সন্ধ্যার পর ভিড় জমান এই স্থানটিতে, ভিড় জমান আশপাশের বহু স্থান থেকে ছুটে আসা প্রেমিক-প্রেমিকারাও। আমি নিজেও জেলা শহরে অবস্থানকালে বহুবার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা জমিয়েছি এই শ্যামল অঙ্গনে।  

হানকাটা ব্রিজ-বর্ষাবিলাস অতিক্রম করে আমতলী, নিমুরিয়া পেরিয়ে এগিয়ে চলছি আমরা ভাদ্রের ভরাদুপুরে। রাস্তার দু’দিকে গাছপালাগুলো মস্তক নুইয়ে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। সঙ্গী সহকর্মীদের বলছিলাম, মনে হচ্ছে সবুজের সমুদ্রেই অবগাহন করছি। দৃষ্টি জুড়িয়ে যাচ্ছিল রাস্তার দুপাশের শাপলাবিল দেখে। এখানকার বিলগুলো সবই বিখ্যাত বেলাই বিলের অংশ বা শাখা বিশেষ।
02
প্রাগৈতিহাসিক কালে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ভূমির সুবিশাল অবনমন এই বেলাই বিল। প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিল জেলার শ্রীপুর, কালিগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিশাল একটি এলাকা দখল করে আছে। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা মূলত: আবর্তিত হয় এই বিলকে ঘিরেই। এই বিল থেকেই আহরিত হয় প্রচুর দেশি মাছ, শুকনো মৌসুমে উৎপাদিত হয় প্রচুর ধানসহ অন্যান্য ফসল। বিচিত্রসব উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্রেরও আধার এই বিল।

আমার দীর্ঘ সময়ের পরিচিত গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. ফরিদ আহমদের মতে, প্রাগৈতিহাসিক কালে প্রলংকরী এক ভূমিকম্পে এই অঞ্চলে বিশাল অবনমনের সৃষ্টি হয়। সেই অবনমনে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের ধারাটিই বেলাই বিলে রূপান্তরিত হয়।

ফরিদ আহমেদ তার তথ্যানুসন্ধান তুলে ধরে আমার কাছে আক্ষেপ করেই বলছিলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক, প্রায় ১৩৫ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও ২৫-৩০টি প্রাণী বৈচিত্র বেলাই বিলে এক সময় থাকলেও মানবসৃষ্ট কারণে ক্রমেই সে সংখ্যার এক চতুর্থাংশই কমে গেছে।     
01
মারতা গ্রাম থেকে আমাদের গাড়ি বামদিকে মোড় নিয়ে নানাইয়া, প্রহলাদপুর, ডুমনী, ফাউগান, বড়চালা, সাটিয়াবাড়ি হয়ে রাজেন্দ্রপুর এসে ঢাকা-কাপাসিয়া সড়কে মিলিত হয়। আমরা যখন নানাইয়া গ্রামের ভেতর দিয়ে ইট বিছানো পথে এগিয়ে চলছিলাম, দু’পাশে বেলাই বিলের এক মোহনীয় রূপ বার বার ভূলিয়ে দিচ্ছিল নির্দিষ্ট গন্তব্য ও অ্যাসাইনমেন্টের কথা। মনে হচ্ছিল এক্ষুণি নেমে পড়ি বিলে, শাপলাবিলের পাতিহাঁসগুলোকে খেদিয়ে একপাড়ে নিয়ে তুলি, শৈশবে ফেলে আসা পাতিহাঁসের দলের মিলিত ‘প্যাক প্যাক’  ধ্বনি শোনার সুতীব্র বাসনার সঞ্চার হয় মনে। দেখতে পেলাম বই-খাতা হাতে গ্রামের বালিকার দল উন্মূখ হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকতে।

লিপিকুশলতার দুর্বলতায় সেইসব মুহূর্তের অসাধারণ সব অনুভূতির সামান্যই ব্যক্ত করা গেলো। নিসর্গপ্রেমে নিত্যদিন হাবুডুবু খাওয়া পাঠকরা সেটা বুঝে নেবেন-এই আশা থাকলো।    

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১২
এআই/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।