মৌলভীবাজার: পাখির রাজ্যে অদেখা পাখির হিসেব কম নয়। দেশের বন প্রকৃতি ধ্বংসের বিবেচনায় তাদের মধ্যে অনেক পাখিই চলে গেছে ‘বিরল’ বা ‘বিপন্ন’ তালিকায়।
যে পাখি সচরাচর দেখাই যায় না বা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন পাখির প্রতি পাখি-বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী বা যাদের পাখি-বন্যপ্রাণীদের প্রতি আগ্রহী রয়েছে তাদের তুমুল আকর্ষণ। অদেখা সেই পাখি-প্রাণীদের হঠাৎ দেখা যেন সোনার হরিণ পাওয়া! এ আনন্দ বর্ণনাতীত।
এমনই একটি পাখি ‘জার্ডনের বাজ’। এটি পুরোপুরি পাহাড়ি বনের পাখি।
সকালের সূর্যালোক তখন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছের ডালে ডালে দোল খাচ্ছে। তার পাশেই চা বাগান। সেখানেও ছায়াবৃক্ষের দীর্ঘ সারি। পাহাড়ি বন এবং বনঘেঁষা চা বাগানের কিছুটা অংশ এ দুটো স্থানই বিচরণভূমি এই পাখিটির।
হঠাৎই এটি লাউয়াছড়া বন থেকে বেরিয়ে বিশ্রাম পূর্বের সূচনা ঘটিয়েছে ছায়াবৃক্ষের ডালে। এ পাখিটিকে এখন প্রাকৃতিক বনে খুবই কম দেখা যায়। দেখা যায় না বললেই বোধহয় সঠিক হবে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক, লেখক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, জার্ডনের বাজ বেশ বড় আকারের পাখি এবং সে আমাদের দেশের বনের পাখি। বন ছাড়া অন্য কোথাও একে পাবেন না। সারা বছরই সে বনে থাকে। আমি বাজের যত ছবি তুলেছি সব প্রায় শ্রীমঙ্গল আর মৌলভীবাজারের মধ্যে। এরা আমাদের দেশের পাখি। কখনোই দূর দেশে যায় না। যেখানেই আছে ওরা সারাবছর এই জায়গায় থাকে। ওরা সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, গিরগিটি প্রভৃতি খায়। বেশিরভাগই হলো সাপ খাওয়া পাখি।
বাংলাদেশে বাজের প্রজাতি সংখ্যা কম আছে। অন্য বাজগুলো ভ্রমণ করলেও জার্ডনের বাজ কোনোদিনই ভ্রমণ করে না। কোনোদিনই এই বন ছেড়ে যে বনে সে জন্মেছে বা তার পাশের বনে থাকে। অন্য কোনো দেশে ভ্রমণ করে না -এটাই এদের বিশেষত্ব। জার্ডনের বাজ চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মাথায় একটা লম্বা ঝুঁটি আছে। যা ঝুলে থাকে। তবে সে নিজ থেকে সেই ঝুঁটিটি খাড়া করতে পারে। বন ছেড়ে কোথাও যায় না এ পাখি।
এ পাখির অস্তিত্ব প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, এখনো ‘সংকটাপন্ন’ বলা হয়নি। কারণ, জার্ডনের বাজের কোনো তথ্য আমরা জানি না। বনের পুরো তথ্য জানা কঠিন। এই পাখির ওপর গবেষণা করতে হলে অনেক লোক মিলে বছরের পর বছর ধরে করতে হবে। সেটা করা হয়নি। সেটা আমরা এখনো করতে পারি না। ওই শক্তি-সামর্থ্য নেই আমাদের। ফলে আমরা এখনো বলতে পারি না বনে পাখিটির কি অবস্থা। সেজন্য সংকটাপন্ন বলার আগে হুবহু তথ্য বলতে হয় যে এই বনে এতোগুলো আছে। যেমন- সংখ্যার হিসেবে গণনার মাধ্যমে বলতে হবে ১০০ থেকে ১৫০। এগুলো আমরা আজও করে উঠতে পারিনি বলে বলতে পারছি না বনে ঠিক কি অবস্থা এই পাখিটির। তবে দেশের বনগুলোর যা অবস্থা এটা দেখে নিশ্চিত করে বলা যায় এদের সংখ্যা অত্যন্ত নিম্ন। যদি সত্যি আমরা এই পাখিটি নিয়ে গবেষণা করি তাহলে হয়তো জার্ডনের বাজ ‘সংকটাপন্ন’ হয়ে যাবে। আমরা শুধু বলতে পারি না তথ্য নেই বলে। আমরা যারা পাখি দেখে থাকি এই দেশে আমাদের অনুমান যে জার্ডনের বাজের সংখ্যা এতো কম যে পাখিটি বিপদে আছে। একেবারে অনুমান করে এটা বলা যায়।
জার্ডনের বাজের ওপর গবেষণা করা উচিত বলে জানান তিনি। বলেন, এমন একটা পাখি দেশ থেকে হারিয়ে যাবে এটা ভাবতেই খুব খারাপ লাগে। এই দক্ষিণপূর্বের কয়েকটা বন ছাড়া সে আরো কোথাও নেই। চট্টগ্রাম হিলটেক আর সিলেট বিভাগের বনগুলোতে। বন তো সে রকমভাবে এখন নেই। তাই জার্ডনের বাজ দেশে খুব বিপদে রয়েছে।
ইনাম আল হক বলেন, এখন বেশিরভাগর বনই টুকরো বন। জার্ডনের বাজ বেঁচে থাকতে হলে বিরাট বনের এলাকা লাগে। কারণ, প্রতিদিন যদি ওর একটা সাপ প্রয়োজন হয়, তাহলে ছোট বন হলে খুবই মুশকিল। সাপ তো আর একটা জায়গা থাকে না। ওর জন্য বড় বন লাগে। যেখানে প্রতিদিন একটা সাপ সে খাবে, তারপরও অনেক সাপ বেঁচে থাকবে। এমন বন কী আছে আমাদের দেশে?
আমাদের দেশে এমন বন প্রায় নেই বলে জানান বরেণ্য পাখি-গবেষক ইনাম আল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২৪
বিবিবি/এসএএইচ