ঢাকা, শুক্রবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ব্যাঙ কুমারের সাফল্য: নতুন করে লেখা দেশের নাম

সাজিদুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৩
ব্যাঙ কুমারের সাফল্য: নতুন করে লেখা দেশের নাম

ঢাকা: বন্ধুরা ডাকেন ‘ব্যাঙ কুমার’, বা ‘ব্যাঙ বালক’ নামে । তবে রূপকথার রাজকন্যার ছোঁয়ায় মানুষ হয়ে ওঠা ব্যাঙ কুমার নয়।

বরং তার ছোঁয়ায় এবার বাংলাদেশের নাম নতুন করে আরেক বার ইতিহাসে লেখা হলো। নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বন্ধু মহলে ‘ব্যাঙ কুমার’ খ্যাত সাজিদ আলী হাওলাদার প্রাণিবিদ্যার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখেছিলেন নিজের এবং দেশের নাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যার সাবেক শিক্ষার্থী এবার আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশের নামকে। শুধু নতুন ব্যাঙ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রেই নয়, নতুন করে একটি ব্যাঙের জেনাস’র (গণ) নামকরণ করেছেন সাজিদ। ছিনিয়ে এনেছেন মেরুদণ্ডী প্রাণীর ‘গণ’র নামকরণের দিক থেকে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি।

আর এ কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে। গত ৯ জানুয়ারি সারা বিশ্বের উভচর প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস নামকরণের অন্যতম স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি নতুন নামের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এর ফলে পৃথিবীর সব দেশের গবেষকরাই নতুন এই নাম ব্যবহার করতে বাধ্য।

‘ফ্যাজারভেরিয়া আসমতি’ বা বাংলাদেশি ঝিঁ-ঝিঁ ব্যাঙ আবিষ্কার করে সাজিদ প্রজাতি আবিষ্কারের দিক থেকে ‘দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ’ বিজ্ঞানী হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

frog`Zakerana` নামের নতুন এই জেনাসের নাম দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা কাজী জাকের হোসেনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ২০ প্রজাতির ব্যাঙের গণ এখন ‘জাকেরানা’ নামে পরিচিত হলো। এর আগের নাম ছিল ফেজারভেরিয়া।

দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগে এই গণের নাম ছিল ফেজারভেরিয়া। সাজিদ আলী হাওলাদার গবেষণা করে দেখালেন দুই অঞ্চলের প্রজাতিগুলোর (species) মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেই থেকেই নতুন নাম দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই প্রক্রিয়া শেষে নতুন এই জেনাসের নামকরণের স্বীকৃতি দেয়। আর এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সাজিদের নামটিও যুক্ত হয়ে যায় প্রাণিবিজ্ঞানের ইতিহাসে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আসমত বাংলানিউজকে বলেন, “মেরুদণ্ডী প্রাণীর নামকরণের দিক থেকে বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম কেউ গণের নামকরণ করলো। বলা যায়, গত দেড়শ বছরের ইতিহাসে প্রথম। এর আগে ইংরেজরা এদেশ থেকে অনেক প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ”
 
গণ আর প্রজাতি
গণ হচ্ছে একটা দল আর প্রজাতি হচ্ছে গণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছোট ছোট দল। অর্থাৎ অনেক প্রজাতির একটা দলের নাম গণ। আবার অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি প্রজাতি নিয়েও একটি গণ হতে পারে।

বর্তমানে ফিনল্যান্ডের ইউনির্ভাসিটি অব হেলসিংকিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত সাজিদ আলী হাওলাদার তার গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, “দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার ‘ফ্যাজারভেরিয়া’ গণের ব্যাঙের প্রজাতিগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ‘আসমতি ব্যাঙ’ নিয়ে কাজ করার সময় বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ধরা পড়ে। পরে আরো গবেষণায় দেখা যায়, জেনেটিক্যালি এবং বাহ্যিক দুই দিক থেকেই দুই অঞ্চলের প্রজাতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে। ”

“২০১১ সালে গবেষণার ফলাফল পাঠানো হয় আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে। গত ৯ জানুয়ারি এটা প্রকাশ করা হয়। ”

ব্যাঙ নিয়ে এত আগ্রহ কেন জানতে চাইলে সাজিদ বলেন, “আসলে বিশ্বের যত প্রাণী আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে ব্যাঙ। এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কার হয়েছে। আর এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ব্যাঙই ঝুঁকিতে রয়েছে। ”

ভবিষ্যৎ কাজের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসলে বাংলাদেশে অনেক গবেষণা হয়, তবে সেগুলো ডিগ্রি অর্জনের জন্য। মৌলিক কাজের জন্য গবেষণা কম হয়। আমি কাজের জন্য গবেষণা করতে চাই। আমার ইচ্ছা আছে এমন একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা যাতে সব ধরনের মানুষ কাজ করতে পারে। ”

“এছাড়া আরেকটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। সেটা হলো, বিজ্ঞানীরা বিলুপ্ত কোনো প্রাণীর ফসিল নিয়ে গবেষণা করে তার বয়স বের করেন। প্রজাতির ডিএনএ পরীক্ষা করে তার টিকে থাকার সময় বের করতে চাচ্ছি আমি। অর্থাৎ একটি প্রজাতি এখন আছে, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে একসময় সেগুলো হারিয়ে যায়। ডিএনএ থেকে তথ্য নিয়ে যদি প্রজাতির টিকে থাকার সময় হিসেব করা যায় তবে প্রাণিবিদ্যা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করতে পারবে। ”

ব্যাঙ গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আসমত বাংলানিউজকে বলেন, “সাজিদের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের নামকে আরো উজ্জ্বল করেছে। এত অল্প বয়সে এতবড় কাজ বর্তমান প্রজন্মের পক্ষেই সম্ভব। ”

সাজিদের সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতির বিষয়টিও তিনি নিশ্চিত করেছেন।

ড. আসমত বলেন, “আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি নতুন এই জেনাসের নামকরণ করেছে। এর ফলে এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সবাই নতুন এই জেনাসের নাম ব্যবহার করতে মোটামুটি বাধ্য। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৩
এসএইচ/আরআর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।