ঢাকা: সেদিন বাজার থেকে বাসায় নিয়ে গেলাম আমলকি। আকর্ষণীয় রং, মার্বেলের মতো আকার দেখে আমার পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট বোনের মেয়ে আগ্রহভরে সেটি হাতে নিলো।
কথাটা সে অবশ্য সত্যিই বলেছে। আমলকি ফল হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি চুলের স্বাস্থ্যের জন্যও ব্যবহার করা হয়। আজকাল তো নানা ব্র্যান্ডের ‘আমলা তেল’ বাজারে বেশ প্রসিদ্ধ।
স্বাদে একটু টক আর কষ লাগলেও আমলকির ভেষজ গুণ চমকে দেওয়ার মতো। এর ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে ব্যবহার করা হয়। আমলকিতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আমলকিতে পেয়ারার চেয়ে ৩ গুণ ও কাগজি লেবুর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। আমলকিতে ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে কমলার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ, আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ, আমের চেয়ে ২৪ গুণ ও কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি।
সংস্কৃত ভাষায় এর নাম ‘আমালিকা’। ইংরেজি নাম – Aamla বা Indian Gooseberry। আমলকি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Phyllanthusemblica বা Emblicaofficinalis।
আমলকি খেলে অনেক রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। এ ফলের গুণাগুণ অমৃত সমান। তাই একে অমৃত ফলও বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি জঙ্গলের গাছ। গাছের পাতা দেখতে তেঁতুল পাতার মতো। শরৎকালে আমলকি গাছে ফুল আসে। ফল ধরতে আরম্ভ করে শীতের শুরুতে। ফলের আকার ছোট বড় হয়। ফল পাকে শীতের শেষ দিকে।
একজন বয়স্ক লোকের প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ দরকার। দিনে দুটো আমলকি খেলে এ পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়।
আমলকি খেলে মুখে রুচি বাড়ে। স্কার্ভি বা দন্তরোগ সারাতে টাটকা আমলকি ফলের জুড়ি নেই। এছাড়া পেটের পীড়া, সর্দি, কাশি ও রক্তহীনতার জন্যও খুবই উপকারি।
আমলকি শুকিয়ে সেই শুকনো ফল রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালবেলা ছেঁকে খালি পেটে শরবত হিসেবে খেলে পেটের অসুখ ভালো হয়।
বিভিন্ন ধরনের তেল তৈরিতে আমলকি ব্যবহার হয়। কাঁচা বা শুকনো আমলকি বেটে একটু মাখন মিশিয়ে মাথায় লাগালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম আসে। কাঁচা আমলকি বেটে রস প্রতিদিন চুলে লাগিয়ে দু’তিন ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এভাবে একমাস মাখলে চুলের গোড়া শক্ত, চুল ওঠা এবং তাড়াতড়ি চুল পাকা বন্ধ হবে।
এছাড়াও আমলকির আরও অনেক ওষুধি গুণ রয়েছে। আমলকি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি সর্দি থেকে উপকার পেতে আমলকির নির্যাস উপকারী। এটি হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের শক্তিবর্ধক।
এছাড়া আমলকি নিয়ে প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে।
প্রাথমিকভাবে আরও প্রমাণ পাওয়া গেছে, রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিস রোগে আমলকির উপকারী। কয়েক ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও এর কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগেও আমলকি কার্যকর বলে ইঁদুরের উপর চালিত গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।
প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগের পরে ক্ষতিগ্রস্ত প্যানক্রিয়াস (অগ্ন্যাশয়) -এর ক্ষত সারাতে আমলকি কার্যকর। আমলকির ফল, পাতা ও ছাল থেকে তৈরি পরীক্ষামূলক ওষুধে কিছু রোগ নিরাময়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে যেমন- ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, প্রদাহ এবং কিডনি-রোগ।
আমলকি মানুষের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে পারে বলে প্রমাণ রয়েছে। ডায়াবেটিক ইঁদুরের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমলকির রস রক্তের চিনির মাত্রা কমাতে ও লিভারের কর্মক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু আজকাল দেশি আমলকির তুলনায় বাজারে বেশি পাওয়া যায় হাইব্রিড আমলকি। এ প্রজাতির আমলকির চাষ এতো বেশি হচ্ছে কেন, এই আগ্রহের জায়গা থেকেই খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, মধুপুরের এক স্থানীয়ের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, আজকাল ওই অঞ্চলে অনেকেই কলম করে আমলকি গাছের হাইব্রিড প্রজাতি বাগানে লাগান। তবে শালবনে দেশি আমলকি গাছ বেশি পাওয়া যেত।
বাজারে হাইব্রিড জাতের আমলকির চাহিদা বেশি থাকাতে দেশি আমলকির কদর কি কমে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাণিবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, একবারেই তা নয়। চাকমা আদিবাসীদের আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ‘তালিক’ অনুযায়ী, এখন যেকোনো আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির জন্য দেশি আমলকিকেই বেছে নেন চিকিৎসকরা। পুষ্টিমানের দিক থেকেও দেশি আমলকির গুণগত মান হাইব্রিড জাতের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
তিনি আরও জানান, আজকাল বনাঞ্চলে আমলকি গাছ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে দায়ী বন বিভাগ। কারণ, বিগত কয়েক বছর ধরে হাতে নেওয়া সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে লাউয়াছড়ার মতো বনাঞ্চলগুলোতে স্থানীয় গাছপালা কেটে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উদ্ভিদ একাশিয়া, ইউক্যালিপ্টাস লাগিয়ে বনের স্বাভাবিক প্রতিবেশ নষ্ট করে ফেলছে। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় আমলকি গাছের মতো বুনো ওষুধি গাছগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। আজ তাই আমলকি যেসব প্রাণী প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো তারা বিপন্নপ্রায়। যেমন উল্লুক, হনুমান।
সাধারণত সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে আমলকি গাছ বেশি দেখা যায়। বনে প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে বুনো এই ওষুধি গাছ। পরিবেশের জন্য উপকারী এ গাছটি মাটি ও বাতাসের জন্যও স্বাস্থ্যকর।
বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আমলকি গাছের মতো একটি উপকারী গাছের প্রয়োজনীয়তা আমাদের প্রতিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য কতটুকু জরুরি, তা জানাতে হবে। প্রশাসনিক মহল থেকেও এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান পরিবেশবিদরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর