চালনা, রামপাল (বাগেরহাট): পশুর নদীর একপাড় বাগেরহাটের রামপালে রাতদিন চলছে কয়লা-তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির প্রক্রিয়া, অপর পাড়েই খুলনার চালনা ইউনিয়ন।
এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে রাতের আঁধারেও নির্বিকারে চলছে বালু উত্তোলনের কাজ, যা পশুর নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে চলছে এই ড্রেজিং প্রক্রিয়া। এভাবে কাজ করার জন্য ড্রেজিং প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়নি, বরং পশুর নদীতে যেখানে নাব্যতা সংকট রয়েছে, সেখানে ড্রেজিং করা প্রয়োজন।
বর্তমানে ড্রেজিং হচ্ছে যে স্থানটিতে, সেখান থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বাজুয়া গ্রামের পাশে নদীতে পড়ে আছে চর। সেখানে ড্রেজিং করা বিশেষ দরকার বলে জানালেন স্থানীয়রা। কিন্তু কম খরচে বালু আনা-নেওয়ার কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছাকাছি একটি স্থান বাছাই করা হয়েছে।
ফলে নদীর স্রোত আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তাই পশুর নদীর পাড়ে অবস্থিত চালনায় এবছর আগের তুলনায় অনেক বেশি নদী ভাঙনের আশঙ্কা করছেন চালনা ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের অধিবাসীরা।
সাধারণত শীতকালে চালনায় নদীভাঙনের প্রকোপ বেড়ে যায়। তবে এবছর বর্ষা শেষ হতে না হতেই এর লক্ষণ চোখে পড়ছে। এখনই গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ভাঙতে দেখা যাচ্ছে। খেয়াঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তায় ভাঙন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ওই এলাকায় কোনো মানুষের মাঝে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই রয়েছে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তায়, নিজেদের ভিটেমাটি হারানোর দুশ্চিন্তায়।
আর চালনা ইউনিয়নটি রামপাল প্রকল্পের সবচেয়ে নিকটবর্তী লোকালয়। পরোক্ষভাবে, চালনার উপর কোনো উচ্ছেদ পরিকল্পনা কার্যকর করা হচ্ছে কিনা, এ ব্যাপারেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এলাকার বিজ্ঞজনেরা।
এদিকে নদীভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে চুনকুড়ি, মৌখালী, পানখালী, বাজুয়ার মতো অনেক গ্রাম। গ্রামবাসীরা ধরনের প্রতিবাদ করেও কার্যকরী কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। চালনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও (পাউবো) জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে মাসখানেক আগে পদক্ষেপ নিয়ে কিছুদিন ড্রেজিং বন্ধ রাখতে সক্ষম হলেও এখন আবার আগের মতোই দিন-রাত ড্রেজিং চলছে।
স্থানীয় হাই স্কুলের শিক্ষক মহিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ কেমন উন্নয়ন! উন্নয়নের কথা বলে সুন্দরবন তো ধ্বংস করবেই, আমাদেরও সর্বহারা করে ছাড়বে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প।
তার নিজের ১৫ বিঘা জমি ক’মাস আগে তলিয়ে গেছে নদীগর্ভে। এছাড়াও পানখালী গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুল এখন ভাঙনের ঝুঁকিতে। বলেও জানান তিনি।
এনজিও কর্মী পলাশ বলেন, চালনা মূলত একটি ত্রিকোণ আকৃতির এলাকা। এর চারপাশে তিনটি নদী রয়েছে। পশুর নদী ছাড়াও ঝপঝপিয়া নদীর স্রোতও আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এর প্রধান কারণ উত্তরের পানি বেড়ে যাওয়া। কিন্তু বর্তমানে যে কাজটি সরকার করছে, তা কোনোভাবেই চালনাবাসীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
তিনি প্রতিষ্ঠানের কাজে প্রায়ই চালনায় যান। চালনা পৌরসভাসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ভাঙনে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, কয়লা তো এমনিতেই মাটি-পানির জন্য ক্ষতিকর। প্রকল্প শুরু হলে কাছাকাছি সবগুলো অঞ্চলের বায়ু পানির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে। কিন্তু প্রকল্প শুরুর আগেই কাছাকাছি লোকলয়গুলোতে যে বিপর্যয় ঘটাতে শুরু করেছে, তা এক কথায় ভয়ানক। অপরিকল্পিতভাবে যদি ড্রেজিং চলে, তবে তা নদীর প্রতিবেশের জন্যও হুমকি। ড্রেজিংয়ের ব্যাপারে আরো সচেতনতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
গত ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।
দুই ধাপে ২৫ বছরে মোট ২৬৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার যোগান দিলেও এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি ঘটাবে বলে জানান তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি।
এছাড়া হুমকির মুখে পড়বে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এসব জানার পর এ কেন্দ্র বন্ধে আন্দোলনে নামে জনগণ। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকার মানুষকে প্রতিবাদে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রামপাল ও চালনার অধিবাসীদের।
এরইমধ্যে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আপামর জনসাধারণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য হুমকি এই নির্মিত হতে যাওয় রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিবাদে আগামী ২৪ তারিখ ঢাকা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত লংমার্চ আহ্বান করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৩
এনকে/এএ/এসআরএস