রায়পুর (লক্ষীপুর): প্রবাসীদের হাত ধরে গ্রাম এগোচ্ছে। বদলে যাচ্ছে প্রত্যন্ত জনপদের চেহারা।
গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন আর নকশাখচিত ভবন। ঘন সবুজের ডালপালা ভেদ করে এ স্বপ্নের বসতি নীল আকাশে উঁকি দিচ্ছে। ভবনগুলোর প্রতিটি ইট যেন প্রবাসীদের কঠোর শ্রমের সাক্ষ্য বহন করছে।
এ গল্প লক্ষীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের মোল্লার হাট গ্রামের। উপজেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের এ গ্রামে সরেজমিন ঘুরে প্রবাসীদের রোজগারে গ্রাম এগিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
মোল্লারহাটের বাসিন্দা হাফিজউদ্দিন ভূইয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিদেশে গিয়ে এ এলাকার লোকজন নিজেদের আর্থিক অবস্থা বদলে ফেলেছেন। কেউ দেশে, কেউবা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। শুধু নিজের অবস্থার পরিবর্তন নয়, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি গ্রামের সামাজিক বিভিন্ন কাজের প্রবাসীদের অংশগ্রহণ আছে। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে প্রবাসী পরিবারগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে।
প্রসঙ্গত, হাফিজউদ্দিন ১৯৯৮ সালে কুয়েত যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তার ভাই আবদুল হামিদ ভূইয়ার মাধ্যমে। ভিসা পেয়েছেন বিনামূল্যে। বিদেশে পাড়ি জমাতে শুধু বিমান ভাড়া দিতে হয়েছিল। ২০০৭ সাল অবধি কুয়েতে ব্যবসা করেছেন হাফিজ। এরপর দেশে ফিরে আবার ব্যবসা শুরু করেন। মোল্লারহাটে নিজে পাকা বাড়ি গড়েছেন। একে একে তার সাত ভাই বিদেশে গেছেন। সবাই পাকা বাড়ি করেছেন। ভূইয়া বাড়িতে এখন সাতটি পাকা ঘর।
গ্রামের আরেকজন সেলিম মিয়াজী সৌদি আরবে ব্যবসা করেন ১২ বছর ধরে। স্ত্রী খালেদা আক্তার সুমা আর তিন সন্তান দেশেই থাকেন। মোল্লারহাট বাজারের কাছে নিজে একটি সুন্দর ডিজাইনের বাড়ি করেছেন। বাবা-মায়ের জন্য করে দিয়েছেন আরেকটি বাড়ি। পাশের বাড়ির এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রথমে মালয়েশিয়া যান সেলিম। এরপর যান সৌদি আরব। সেই সময় তার যেতে খরচ হয়েছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। বহু কষ্টে ওই টাকা যোগাড় করলেও এখন তিনি বিপুল অর্থের মালিক।
সূত্রে জানা যায়, গ্রামে অধিকাংশ বাড়ি এখন পাকা। গ্রামের মোল্লা বাড়িতে ১১টি, মিয়াজী বাড়িতে ১৩টি, পন্ডিত বাড়িতে ৯টি, ভূইয়া বাড়িতে ৭টি, সুকানি বাড়িতে ১০টি, দেওয়ার বাড়িতে ১২টি পাকা ঘর উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসেছে নলকূপ। ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে গ্রামে।
অথচ কিছুদিন আগেও এ অবস্থা ছিল না। গ্রামের বাজারে উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের ডাকঘরটিতে একসময় প্রবাসীদের চিঠি আসতো। মোবাইল প্রযুক্তির যুগে চিঠির বিলুপ্তি ঘটেছে। প্রবাসীরা কিংবা গ্রামে থাকা তাদের স্বজনেরা এখন আর প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় প্রহর গোণেন না। প্রয়োজনে মোবাইলেই তাৎক্ষণিক আলাপ সেরে ফেলেন।
স্থানীয় সূত্র বলছে, এ গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে আছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, দুবাই, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর। এ উপজেলার ইউনিয়নগুলোর মধ্যে কেরোয়ায় বিদেশে থাকা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।
আর এ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত মোল্লারহাট গ্রামে ইউনিয়নের অন্য গ্রামগুলোর চেয়ে বেশি মানুষ বিভিন্ন দেশে থাকেন। বছরের পর বছর বিদেশে অবস্থান করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এ মানুষগুলো নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রামের অবস্থাও বদল করছেন। তাদের শ্রমের সুফল পাচ্ছে দেশ।
মোল্লারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মিজানুর রহমান মোল্লা জানান, গ্রামের অনেক লোক বিদেশে যাওয়ার কারণে তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করতে পেরেছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর বিষয়ে তাদের আগ্রহ বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে এ বিদ্যালয় থেকে মাত্র ৮-১০জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও এখন এ সংখ্যা ৫০ জন। গ্রামের মানুষ শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। গ্রামের সামাজিক কাজেও অংশ নিচ্ছেন প্রবাসীরা।
সরেজমিনে জানা যায়, রায়পুরে প্রবাসীদের টাকা দেশে আসে ব্যাংকের মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি টাকা আসে ইসলামী ব্যাংক রায়পুর শাখায়। ওই শাখার ম্যানেজার অপারেশন্স মো. হাফিজুর রহমান জানান, গত এক বছরে রায়পুরে রেমিটেন্স এসেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
মোল্লারহাট বাজারে বাংলানিউজ টিমের সামনে প্রবাসীদের গল্প উঠতেই স্থানীয় লোকজনের ভিড় জমে। তারা জানান, আত্মীয়-স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশির সূত্রে মোল্লারহাট গ্রামের মানুষ বিদেশে যাওয়ার ভিসা পাচ্ছেন।
এক ভাই আরেক ভাইকে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরা নিকট আত্মীয়দের নিতে ভিসা পাঠাচ্ছেন। একটি ভিসা এলে গ্রামের একমাত্র বাজারের চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ ভিসা গ্রামের আরও একজন মানুষের ভাগ্য বদলাবে।
এ গ্রামের বাসিন্দাদের মতে, চেষ্টা করে গ্রামের সবাই যে বিদেশে যেতে পারছেন, তা নয়। বিদেশে যাওয়ার অধীর আগ্রহ নিয়ে টাকা খরচ করে পাসপোর্ট বানিয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে ঘরে ফেরেন। বিদেশে যাওয়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজ গ্রামে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার কাজে মানোনিবেশ করেন তারা। তবে বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে এ গ্রামের কেউ প্রতারকের খপ্পড়ে পড়েছেন বলে এখনো শোনা যায়নি।
বছর ছয় ওমানে থাকার পর দেশে ফেরা জসিম মোল্লা বললেন, ভিসা আর টাকা যোগাড় করে প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে গিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। খেজুরের বাগানে কর্মরত শ্রমিকেরা প্রচন্ড গরমে দিশেহারা হয়ে পড়েন। কম্বল ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে গরমে কিছুটা শান্তি খুঁজে বেড়ান।
সেই প্রবাসীদের টাকা আসে এ দেশে। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশিরা উপকৃত হন। এমনকি গ্রাম কিংবা দেশের উন্নয়নেও প্রবাসীদের ভূমিকা আছে। কিন্তু প্রবাসীদের কষ্টের খোঁজ কেউ রাখে না।
২০ বছর কাতারে অবস্থানকারী গ্রামবাসী হোসেন আহম্মদ এখন ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার। তিনি বলেন, ইউনিয়নের মধ্যে এ গ্রামের সবচেয়ে বেশি লোক বিদেশে থাকে। বিদেশে অবস্থানের ফলে বাড়িঘরের অবস্থা বদলেছে। অনেকে জমি কিনেছেন, ব্যবসা করছেন। শিক্ষা ও সচেতনতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে।
কবে, কীভাবে এ গ্রামের মানুষের বিদেশে যাওয়ার শুরু হয়, সে সম্পর্কে গ্রামবাসী কিছুই জানা নেই। তারা জানালেন, স্বাধীনতার পর থেকেই গ্রামের মানুষ বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে বিদেশে গিয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জনের মাত্রা বাড়তে থাকে।
এ গ্রামের লোকজন বিভিন্ন দেশে গিয়ে খেজুরের বাগানের শ্রমিক, কোম্পানির কাজ, বিল্ডিংয়ের নির্মাণ শ্রমিক, পাইপ ফিটার, দোকানের কর্মচারীর কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা করেন।
কেরোয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, ইউনিয়নের পাঁচ হাজারের বেশি লোক বিদেশে থাকেন। এসব পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। দারিদ্র্যতা কমেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৩
আরআই/কেকে/এসএইচ/এসআর/এমজেডআর