উপকূল ঘুরে: বিপন্ন ঘরগুলো ক্ষণস্থায়ী। আজ এখানে তো কাল ওখানে।
এখন থাকেন বাঁধের ঢালে, অন্যের জমিতে কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আশপাশের খোলা জায়গায়। নদী-ভাঙন আর জোয়ারের পানির তোড়ে এদের প্রায় প্রতিমাসেই একাধিকবার ঘরের জায়গার খোঁজে বের হতে হয়।
হয়তো ঘর বানানোর জন্য এক টুকরো জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু ঘর তোলার সামর্থ্য নেই। কোনোমতে চালা বানিয়ে অথবা তাবু টাঙিয়ে দিন পার করছেন মানুষগুলো। বাঁধের পাশে ঘর বানানো হয়েছে ঠিকই, অথচ সে ঘরের নিচের বিরাট ফাঁকা দিয়ে জোয়ারের পানিতে গোটা ঘর সয়লাব। পানির সঙ্গে কখনও ঘরে ঢুকে পড়ে বিষাক্ত সাপ। তখন ঘরের শেষ সম্বল মালামাল ফেলে আবার অন্য কোনোখানে আশ্রয়ের সন্ধান।
উপকূলের বিপন্ন মানুষগুলোর ভাসমান জীবনের চেহারা এমনই। প্রতিনিয়ত উপকূলবাসী খেটেখাওয়া মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। ভোলার রামদাসপুর, দৌলতখানের ভবানীপুর, মদনপুর আর রামগতির আলেকজান্ডারের এ ভাসমান মানুষেরা বাংলানিউজকে কাছে পেয়ে জানালেন, এ দুর্যোগ প্রতি বছরই তাদের সামনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। আরও বেশি প্রবল বেগে জোয়ারের পানি ঘরে ঢোকে। ভাঙনের তীব্রতা আরও অনেক বেড়েছে। সঙ্গে বাড়ে হতদরিদ্র মানুষগুলোর সংকট।
বিশেষজ্ঞেরা এ অবস্থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আর গোটা বাংলদেশের মধ্যে উপকূল অঞ্চলের ঝুঁকি আরও বেশি। এরই প্রভাব পড়ছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায়। উপকূলের মানুষের কথা ও ছবিতে তাদের বিপণ্নতার চিত্র উঠে আসে বাংলানিউজের সরেজমিন প্রতিবেদনে।
রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের কাছে আসলপাড়ার সুরাইয়া বেগমের আগে আরও তিনবার ঘর সরিয়ে নিয়েছেন মেঘনার তীর থেকে। এখন আবারও ঘরের দুয়ারে মেঘনা। এ ভয়াল নদী জোয়ারের পানিতে ফুলে উঠলে ঘরের কাছে পানি চলে আসে। তবুও পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখানেই ছিলেন। কিন্তু আর নয়। অবশেষে আবারও ঘরখানা সরিয়ে নিতে হলো। ভিটের ওপরে থাকা পানির পাত্র আর ঘরের চালার একটি অংশ এখনো সরানো হয়নি।
ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর এলাকায় মেঘনার তীরে বাঁধের বাইরে থাকেন আরজু বেগম। স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। নিজের হাতে কোনো কাজ নেই। দুদিন আগে এ ঘরখানা বদল করেছেন। খুঁপড়ি ঘরের ভেতরে এককোণে কিছু লাকড়ি। আরেক কোণে খাবারের থালাবাটি, হাড়ি-পাতিল।
নড়বড়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে মাচা পাতা হলেও জোয়ারের পানি বাড়লে ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁধের ভেতরে ঘর বানানোর জায়গা পাননি। একদিকে জীবিকার তাগিদে অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা। অন্যদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়ায় এ বিপন্ন পরিবারটি।
ঘরের নিচের মাটি সরে গেছে
ভবানীপুরের বাঁধের পাশে আকলিমা বেগম ঘরের দরজায় বসে আনমনে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। বিপন্ন মানুষদের দুর্ভোগের চিত্র দেখতে দেখতে বাঁধ দিয়ে হেঁটে যেতে হঠাৎ চোখ যায় তার ঘরের দিকে।
মাটি সরে গিয়ে ঘরটির ঠিক অর্ধেক স্থানজুড়ে বিশাল গর্ত হয়ে গেছে। গর্তের ওপরে কাঠের একটা নড়বড়ে চৌকি। এখানেই রাতে ঘুমান তারা। অন্য কোথাও থাকার জায়গা পাননি বলে এখানেই ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। জোয়ারের পানি এদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। কেউ খোঁজ নিতে আসে না।
জোয়ারের সময় পরিত্যক্ত চরের ঘর
ভয়াল মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে ভোলার দৌলতখানের মদনপুরা চরে যেতে হয়। জোয়ারের পানির ওপর ভর করে বেঁচে থাকে সেখানকার মানুষ। পানিতে সব কিছু ডুবে গেলে কাজকর্ম থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সব কাজই বন্ধ হয়ে যায়।
মাথা গোঁজার ঘর বানানোর জন্য এক টুকরো জমি হয়তো এ বিপণ্ন মানুষগুলোর ভাগ্যে জুটেছে। কিন্তু দিনেরাতে দুবার জোয়ারের পানি এদের জীবনযাত্রা একেবারেই এলোমেলো করে দেয়। সেখানে দেখা গেলো মদনপুরা চরের বিবি খাদিজা দুপুরে ঘরের রান্না ফেলে উঁচু স্থানে বসে আছেন।
খোলা আকাশের নিচে এভাবে বসবাস
বারবার ঘরপোড়া মানুষগুলোর এভাবে খোলা আকাশের নিচে বসবাসের চিত্র উপকূল অঞ্চলের সাধারণ ছবি। ছবিটি ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের রামদাসপুর চরের। মেঘনার ভাঙন কিনারে চলে এলে আবার মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য শুরু হয় নতুন দৌঁড়ঝাপ।
কতবার আর ঘর বানানো যায়। তাইতো মাথার ওপর কিছু একটা টাঙিয়ে এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকার তাদিগে দিন কাটায়। এখানেই থাকা-খাওয়া, অবসরে বিশ্রাম নেওয়া, রাতে ঘুমানো। এভাবেই কাটে এসব লড়াকু মানুষের প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/পিসি/আরকে