ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

আগে সুন্দরবন, পরে বিদ্যুৎকেন্দ্র

নূসরাত খান, এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৩
আগে সুন্দরবন, পরে বিদ্যুৎকেন্দ্র

লংমার্চ থেকে ফিরে: প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে বিদ্যুৎ ছাড়া ভাবা যায় না এক মুহূর্তও। আর তরুণ সমাজের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা যেন একটু বেশিই।

কারণ, কম্পিউটার-ইন্টারনেট তাদের নিত্যসঙ্গী। ফেসবুক, টুইটার, নিউজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চায় না তারা। তবু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে কেন কথা বলছেন এতো লোকজন?

কারণ, প্রযুক্তি নির্ভর তারুণ্যের বুকে নেই বিদ্যুতের জন্য সব ধ্বংসের তাণ্ডব। তারা সবুজকে বুকে ধারণ করে সুন্দরবন বাঁচাবার অঙ্গীকারে পথে নেমেছেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা ঢাকা-সুন্দরবন লংমার্চে অংশ নেন সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষ। যার বেশিরভাগই তরুণ।

তেমনই একজন তরুণ মারজয়, ঢাকার গণবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বন্ধুদের সঙ্গে চলে আসেন সুন্দরবন রক্ষার ডাক দিতে। লংমার্চের পুরোটা সময়ই সুন্দরবনের অজানা সব জীববৈচিত্র্যের গল্প বলে গেলেন আশপাশের বন্ধুদের।

অন্যদিকে, রাজবাড়ীর শ্যামল বললেন, এ ধরনের একটি জাতীয় সমস্যার জন্য এগিয়ে না আসার কোনো কারণই নেই। ভারতীয় এনটিপিসি নিজের দেশে তো কোনো সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতির কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানায়নি। তবে আমাদের দেশে কেন এই পরীক্ষা করতে আসছে?

লংমার্চের সমগ্র তরুণ দলও স্লোগানে স্লোগানে ভারতকে তাই জানিয়ে দিতে চায় যেন, ‘নিজের দেশে পারো না, আমার দেশে আসো ক্যান?’

দিন-রাত খেটে, রোদ- বৃষ্টি উপেক্ষা করে একই রকম উদ্যোমে স্লোগান দিতে ক্লান্তি নেই কারও। কিসের চিন্তায় তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে?

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ছাত্র রায়হান বলেন, এদেশের মা হচ্ছে সুন্দরবন। কোনো উন্নয়নের কথা বলে অনন্য সুন্দর এই প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। আর ইরাবতী ডলফিনের মতো একটি বিপন্নপ্রায় প্রাণীর অভয়ারণ্য নষ্ট করতে দিলে কখনই এদেশের স্বাভাবিক প্রতিবেশ টিকিয়ে রাখা যাবে না।

লংমার্চের দ্বিতীয় দিন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহীর ঘোষণা আসে, রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হবে ২২ অক্টোবর। আর এ ঘোষণায় লংমার্চের গতি যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদের ঝড় আরও হাওয়া দেয় যেন।

সেইরাতে ফরিদপুরে অবস্থানরত লংমার্চ দলের কাছে বিভিন্ন সময় স্থানীয়রা এসে জানতে চান, আসল বিষয়টা কি? তেমনই একজন ফরিদপুরের স্থানীয় অধিবাসী জামাল। তার মতো কয়েকজন সহমত জানিয়ে যুক্ত হয়ে যান লংমার্চে। বিদ্যুতের ঘাটতি থাকার পরও সুন্দরবনের ধ্বংস ঠেকাতে তারা একাত্ম।

লংমার্চের শেষ দিনে বাগেরহাট থেকে দিগরাজে যাওয়ার সময় জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী কল্লোল মুস্তাফা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষের দিকে তাকিয়ে বলেন, এদের কাউকে বাসা থেকে ডেকে আনা হয়নি। নিজেদের তাগিদেই তারা এসেছেন।

তারাও জানেন, বনায়ন ছাড়া বাংলাদেশ টিকবে না। বিদ্যুতের দাবি আমাদের থেকে তাদের বেশি। কিন্তু তারাই আবার সুন্দরবনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। সুতরাং, সুন্দরবন রক্ষার দাবি আগে, বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্য কোনো জায়গায়ও স্থাপন করা যেতে পারে।

বাগেরহাটের জনসভায় দলে দলে স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের যোগ দিতে দেখা যায়। তারা নেচে-গেয়ে, স্লোগান দিয়ে নিজেদের সংহতির কথা জানিয়ে দেন।

অন্যদিকে, লংমার্চের এক ফাঁকে রামপালের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে চলে যান ঢাকা থেকে যোগ দেওয়া একদল তরুণ। সেই দলের একজন প্রিয়ম।

তিনি বলেন, রামপালে যেতেই রীতিমতো অভিযোগের বানে ভেসে যাচ্ছিলেন তারা পাঁচ বন্ধু। কেন এই অভিযোগ? কারণ, ঢাকা থেকে মানুষ কেন এতো দেরিতে এলেন সুন্দরবন রক্ষার কথা বলতে। তাদের অভিযোগ, লংমার্চ আরও আগে হওয়ার দরকার ছিল। তাহলে, এ ধরনের অযৌক্তিক পরিকল্পনার কথা এতো ফলাও করে বলতে পারতো না সরকার।

সমাপনী জনসভায় তারই প্রতিফলন চোখে পড়ে। প্রায় ২০-২৫ হাজার লোকের সমাগমে সুন্দরবন বাঁচাবার স্লোগান। প্রতিবাদী মানুষের উপস্থিতিতে মুখর দিগরাজের সভা প্রাঙ্গণ। সেখানেই সুন্দরবন ঘোষণা পাঠ করেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
 
এতে জানানো হয়, রামপাল প্রকল্প সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে হলেও ২৬ সেপ্টেম্বর সরকারের প্রেসনোটে বলা হয়, ‘ইউনেস্কো ন্যাশনাল হেরিটেজ’ সাইট থেকে নাকি ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

প্রকৃতপক্ষে, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে। ন্যাশনাল হেরিটেজ সাইট বলে কিছু নেই। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে জালিয়াতি করা হচ্ছে। সরকারের এসব চেষ্টা ব্যর্থ হবে।

আর মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।

বিকল্প বিদ্যুতের উৎসকে ব্যবহারের চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান সরকারকে। অবিলম্বে সুন্দরবন নীতিমালা তৈরির প্রস্তুতি নেওয়ারও দাবি জানান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

জনসভায় তিনি বলেন, এ ধরনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের তারিখ ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। জনগণ এই ভিত্তিপ্রস্তর উপড়ে ফেলবে। সেইসঙ্গে ২২ অক্টোবর সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত কখনই বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না।
 
এই প্রকল্প বাতিল না করলে ১২ অক্টোবর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে আবার মাঠে নামবে জাতীয় কমিটি।

এ ঘোষণায় বিপুল জনসমর্থন পাওয়ার পর সুন্দরবন ঘোষণাকে গণরায়ে পরিণত হওয়ার কথা বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

সফলভাবে শেষ হওয়া লংমার্চ থেকে আগামী ১১ অক্টোবরের মধ্যে সরকারকে রামপাল প্রকল্প বাতিলের আল্টিমেটাম দেয় জাতীয় কমিটি।

তারুণ্যের শক্তি সাধারণের শক্তিতে পরিণত হয়ে জাতীয় অধিকার রক্ষা করবে এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৩
এনকে/এএ/এএসআর/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।