সুন্দরবন থেকে ফিরে: ভোর না হতেই পৌঁছে গেলাম সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনীতে। জেটিতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই হাতের কাছে থাকা কেওড়া গাছ দেখিয়ে ড. আনিসুজ্জামান বলে উঠলেন, কেওড়ার ফল হরিণ আর বানরের কাছে আমাদের কাচ্চি বিরিয়ানির মতোই লোভনীয়।
প্রকৃতি পাঠের একটি অভিনব ভাবনা থেকে ‘জঙ্গলবাড়ি’ নেচার ক্যাম্পের আয়োজন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কিছুদিন আগে এই নেচার ক্যাম্পের ক্যাম্পাররা সুন্দরবনের প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে জানতে ছুটে গিয়েছিল সেখানে। সাথে ছিলেন সুন্দরবন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করতে থাকা গবেষক ড. আনিসুজ্জামান খান।
বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তে জোয়ার-ভাটায় নির্ভরশীল ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সেজেছে তার নিজস্বতায়। আর সেই সুন্দরবনের গাছ চেনার প্রয়াসেই সেখানে গিয়েছিল ৩২ জনের একটি দল।
সবগুলো গাছের পাতাই সমতলের গাছ থেকে কিছুটা ভিন্ন, একটু শক্তও। ড. আনিস বললেন, লবণাক্ততার সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই পাতার ওপর মোমের মতো শক্ত একটি প্রলেপ রয়েছে।
নৌকায় যেতে যেতে কিংবা বিভিন্নস্থানে যাত্রা বিরতিতে চলে বিভিন্ন জানা-অজানা প্রকৃতি সম্পর্কিত আলোচনা।
বিভিন্ন গাছের শ্বাসমূলের বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করল দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ক্যাম্পার ১০ বছরের রুদ্র।
স্কুলের বাইরে তার আগ্রহের বিষয়বস্তু শুধুই বনের প্রাণী আর উদ্ভিদ।
তথ্যটি জানতে ড. আনিসের কাছে গেলে তিনি জানালেন, শ্বাসমূল সুন্দরবনের উদ্ভিদদের লবণাক্ত পানিতে বেঁচে থাকার সহায়ক। এই বন একটি জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন। আর তাই নদীর ধার ঘেঁষে বেড়ে ওঠা বনকে দেখলে মনে হবে যেন প্রকৃতি নিজেই মালির পটু হাতে বাগানের সবগুলো গাছকে একমাপে ছেঁটে দিয়েছেন।
শ্বাসমূল ছাড়াও একটি বিশেষ আকৃতির মূল রয়েছে সুন্দরী গাছের। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বাট্রেস রুট’।
অনেকটা ‘পিড়ি’ আসনের মতো দেখতে মূলটি সুন্দরী গাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। স্থানীয়দের বিয়েতে কনেকে বিয়ের পিড়ি হিসেবে এই ‘বাট্রেস রুট’ উপহার দেয়ার প্রচলন রয়েছে। মূল নিয়ে কথা বলতে বলতেই ড. আনিস জানালেন সুন্দরী গাছ নিয়ে আরও কিছু তথ্য।
এই ম্যানগ্রোভের অনন্য একটি প্রজাতির নাম সুন্দরী গাছ। বনের নামকরণটা এই গাছ থেকেই হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই আগা মড়া রোগসহ আরও কিছু ম্যানগ্রোভের গঠনগত কারণেই কমে আসছে সুন্দরী গাছের সংখ্যা।
ভূমির উচ্চতা বাড়তে থাকলে জোয়ার-ভাটার প্রভাব কমতে থাকে ম্যানগ্রোভে। আর সাথে সাথে ভাঙনের প্রভাব কাটিয়ে মাটিও স্থায়িত্ব অর্জন করে। যা সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও সত্য। তাই, সুন্দরবনের বয়স বাড়ার সাথে সাথেই সুন্দরী গাছের মতো গাছের বিলুপ্তি ঘটবে স্বাভাবিক নিয়মে। একইসাথে যুক্ত হবে নতুন নতুন উদ্ভিদ।
অন্যদিকে, গর্জন গাছের মূলও বেশ অদ্ভুত। ইংরেজিতে এর নাম Rhizophora. এই গাছটির মূলগুলো অনেক লম্বা লম্বা আর মাটি থেকে অনেক ওপরে থাকে। এর ফলগুলোও গাছ থেকে মাটিতে পড়ার সময় খাড়াভাবে পড়ে, লবণাক্ততার সাথে খাপ খাইয়ে বাঁচার জন্য।
গোলপাতা গাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করতেই করতেই ক্যাম্পাররা পার করে দিলেন পুরো একটি রাত। ড. আনিস বললেন, গোলপাতা গাছের পাতা শুধু ঘর কিংবা নৌকা বানানোর কাজে ব্যবহার করা হলেও এর ফলও ভীষণ উপকারি। অর্থনৈতিকভাবে এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করতে পারে। গোলপাতার ফল দিয়ে ওয়াইন (মদ) তৈরি করে রফতানি করা গেলে একটি সম্ভাবনাময় খাত সৃষ্টি হতে পারে।
সুন্দরবনের বৈচিত্র্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই। আর তাই পরিবেশ সচেতন মানুষকেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পর্যটনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে আসা দরকার বলে পরামর্শ দিলেন বিভিন্ন পরিবেশবিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৩
এনকে/এসএফআই/আরআইএস