শিল্পায়ন ও উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদ্যুত। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ শক্তির একটি বিরাট অংশ (৮৬%) আসে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা যদি বর্তমান হারে গ্যাস খরচ করে চলি, তাহলে আমাদের এ মজুদ গ্যাস খুব অল্প সময়ে শেষ হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই সার উৎপাদন এবং গৃহস্থালি কাজের মতো বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করছি প্রাকৃতিক গ্যাস। আমাদের কয়লার মজুদও সামান্য এবং পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা সীমিত। তাহলে আমাদের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা কীভাবে মিটবে?
বিদ্যুৎ ছাড়া শিল্পায়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আত্মনির্ভরশীলতা কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের একই সঙ্গে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হবে, আবার কমাতে হবে প্রাকৃতিক গ্যাসের খরচ।
বিশ্ব এখন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎসের স্বল্পতা নিয়েই চিন্তিত নয়, এসব প্রাকৃতিক জ্বালানি পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা নিয়েও অনেক বেশি চিন্তিত। জ্বালানি সম্পদের স্বল্পতা এবং অত্যধিক জনগোষ্ঠীর চাপে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের জন্য সে চিন্তা আরও বেশি।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ যেহেতু সন্তোষজনক নয়, কাজেই আমাদেরকে হাত বাড়াতে হবে নতুন জ্বালানি উৎসের দিকে।
আজ শুধু পশ্চিমারাই নয়, এশিয়ার অনেক দেশও খোঁজ করছে দুষণমুক্ত জ্বালানি উৎসের। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং থাইল্যান্ড অনেক এগিয়ে গেছে উপকূলীয় বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং প্রতি বছরই তারা বাজেট বৃদ্ধি করছে এই ক্ষেত্রে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, ৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উইন্ড টারবাইন প্রতিবছর প্রায় ১,১০০ টন জীবাশ্ম জ্বালানির খরচ বাঁচাতে পারে।
বায়ু প্রবাহ মাত্রার বিচারে পতেঙ্গা, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দীপ, হাতিয়ার মতো উপকূলীয় অঞ্চল উইন্ড টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। যা বর্তমানে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চলছে ও ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
বায়ু শক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা এ শক্তি অফুরন্ত। এর কোনো শেষ নেই। প্রকৃতি তার অমোঘ নিয়মে আমাদের বাতাস দিয়ে চলে। শুধু প্রয়োজন উইন্ড টারবাইনের সাহায্যে তা থেকে শক্তি আহরণ করা। ফলে অন্যান্য উৎসের তুলনায় বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও অনেক কম।
বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে আমরা আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারি। চিংড়ি চাষ, লবণ উৎপাদন এবং বরফ শিল্পের মতো খাতগুলোতে বায়ুশক্তি যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। রেশম চাষ, কৃষি, পোল্ট্রি, ধানের খোসা ছড়ানো, গৃহ আলোকিত করার কাজেও এ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা পেতে পারে।
তবে বায়ুশক্তির উপযোগিতার কথা চিন্তা করতে গেলে অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে এর সামাজিক উপযোগিতা। পল্লি অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অনেকখানি নির্ভর করে শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ওপর। যার জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে অর্থাৎ শহর থেকে দূরবর্তী পল্লি এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বায়ুশক্তি একটি উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারে। এর একটা স্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। যা আমাদের পল্লি এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে গতির সঞ্চার করতে পারে। এ ধরনের উন্নয়ন প্রক্রিয়া কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে এবং দেশ বিদেশ যাওয়ার যে প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে তা অনেকখানি কমিয়ে দেবে।
উল্লেখ্য, ইউরোপীয় দেশগুলোর পল্লি এলাকায় এ ধরনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংগঠিত হয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল উইন্ডমিলের। উইন্ডমিল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির মাধ্যমে পল্লি অঞ্চলে ছোট ছোট শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বাড়বে এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এছাড়া সূর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় গ্রামের মানুষের কর্মঘণ্টা অনেক কম। গ্রামের মানুষ সাধারণত সকাল ৮টার পর কাজ শুরু করেন। গোধূলির পর পরই কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বায়ুশক্তি চালিত উইন্ডমিল বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের দীর্ঘ রাত্রির এই কর্মহীন সময়কে কর্মমুখর সময়ে পরিণত করতে পারে। সর্বোপরি, বায়ুশক্তির ক্ষেত্রে সিস্টেম লসও হবে খুব কম।
অর্থাৎ সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে সব সুবিধা উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো-
ক. কোনো পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা নেই।
খ. আমদানি করা জ্বালানির সাশ্রয়।
গ. প্রাকৃতিক গ্যাসের খরচ রোধ।
ঘ. সহজ ও সুলভ রক্ষণাবেক্ষণ।
ঙ. যে কোনো অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা।
৬। প্লান্ট স্থাপনের জন্য অল্প জায়গার প্রয়োজনীয়তা।
আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং দ্বীপগুলোতে বাস করছে অসংখ্য মানুষ। প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রাকৃতিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে এসব এলাকার উপযোগিতাও অনেক বেশি। চিংড়ি চাষ, মাছধরা ও মাছের চাষ, লবণ উৎপাদন ও কৃষির জন্য এ অঞ্চলসমূহে রয়েছে অত্যন্ত সুবিধা এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগতে পারলে আত্মনির্ভরশীলতার পথ বেয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানো হয়তো কঠিন কথা নয়।
বিদ্যুতের সাহায্যে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ চাষের ক্ষেত্রে সেমি-ইনটেনসিভ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে এর উৎপাদন ২৫-৩০ ভাগ বাড়ানো সম্ভব। হিমায়িত করার বরফের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক মাছ। এসব দূরবর্তী স্থানে বরফ ফ্যাক্টরি তৈরি ও বরফ সরবরাহের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের সাহায্যে সাগরে লবণাক্ত পানিকে উচ্চ ভূমিতে ঠেলে দিয়ে লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব। যা আমরা লবণ আমদানির জন্য ব্যয় করে থাকি।
এসব এলাকায় জাতীয় গ্রিডের সাহায্যে বিদ্যুৎ নেওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। আবার জীবাশ্ম জ্বালানি বহনও ব্যয়বহুল। কিন্তু এসব উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। অর্থাৎ বায়ুশক্তি আমাদের নিয়ে যেতে পারে দারিদ্র্য দূরীকরণ, আত্মনির্ভরশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
email.dr.fourkanali@gmail.com.
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৩
এএ/এমজেডআর