হরিহর নগর (খেশরা, তালা, সাতক্ষীরা) থেকে: কেউ উঠেছে গাছের ডালে, কেউবা টিনের চালে। নদীর দুপাড়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুরা।
প্রসঙ্গত, সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে আসছে। আর এ আয়োজন ঘিরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের হরিহর নগর ছাড়াও আশপাশের গ্রামগুলোতে সোমবার নেমে এসেছিল ভিন্ন মাত্রার এক উৎসব।
এখানে গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছোঁয়া। মাইকের আওয়াজে দলে দলে ছুটে আসা মানুষের মিছিল। নৌকা বাইচ ঘিরে গ্রামের মানুষের এ এক ভিন্নমাত্রার মিলনমেলা। আর ধনী-গরিব আর বয়স নির্বিশেষে সেখানে সামিল হয়েছে গ্রামের সব শ্রেণি পেশার মানুষ।
শিশুরা ভালো জামাকাপড় পড়েছে, মেয়েরা সেজেছে, নারীরা পড়েছেন ভালো শাড়ি। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ছুটে এসেছেন খেশরা ইউনিয়নের পাকুড়িয়া নদীর তীরে। এখানে নৌকা বাইচের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বেশ কদিন আগেই।
স্থানীয় লোকজন বাংলানিউজকে জানালেন, এটাই এ এলাকার মানুষের এক ধরনের বিনোদন। যেখানে জীবিকার তাগিদে মানুষের বহুমুখী ব্যস্ততা, এক মুহূর্ত সময় নেই অবসরের, সেখানে দীর্ঘদিন পর নৌকা বাইচের এ প্রতিযোগিতা এলাকাবাসীকে দিয়েছে বাড়তি বিনোদনের খোরাক।
বৌচি, কানামাছি, দাঁড়িয়া বাঁধা, হা-ডু-ডু ছাড়াও গ্রামীণ সব খেলাধুলা যেখানে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, সেখানে হরিহর নগরের এ নৌকা বাইচের আয়োজন গ্রামবাসীকে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছে। বাইচ দেখতে আসা গ্রামের বয়সী ব্যক্তিদের মুখে তেমনই আশার আলো।
এ প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ আলিমুদ্দিন বলেন, গ্রামে তো আগে অনেক খেলাধুলা হতো। এখন কিছুই নাই। গ্রামের কিছু মানুষের উদ্যোগে এ বাইচের আয়োজনে আমরা খুব আনন্দিত।
কার্তিকের পড়ন্ত বিকেলে পাকুড়িয়া নদীর পাড়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। মাইকের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরে বেড়ে চলে জমায়েত। নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে নৌকা বাইচ উপভোগে। সুতলির সঙ্গে রঙিন কাগজ লাগিয়ে বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী নৌকা আসার পথ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে প্রতিযোগী নৌকাগুলো ছুটে আসে মঞ্চের দিকে। এ সময় নদীর দুপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিদিক।
অংশগ্রহণকারী নৌকাগুলোকে এভাবে তিনবার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়েছে। এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় বিজয়ী। প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে সোনাবাধাল দল। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকে মশিয়াডাঙ্গা দল।
বিজয়ী দলের প্রধানের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধান অতিথি তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার। স্থানীয় ইউপি সদস্য শামসুল হকের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন খেশরা ইউপি চেয়ারম্যান এস এম লিয়াকত হোসেন, কপোতাক্ষ নিউজের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি আ. জব্বার সর্দার।
প্রসঙ্গত, ১৯৮০ সাল থেকে এ এলাকায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমানে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে হরিহরনগর কপোতাক্ষ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। এলাকার মানুষের বিনোদন আর নৌকা বাইচের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ধরে রাখা প্রতিযোগিতা আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানালেন উদ্যোক্তারা। স্থানীয় সূত্রগুলো এমন তথ্যই দিয়েছে।
আয়োজকদের তরফে ইউপি সদস্য শামসুল হক বলেন, নৌকা বাইচ এ এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এলাকায় অন্য কোনো ধরনের বিনোদনের সুযোগ নেই। বছরান্তে এ আয়োজন এখানকার মানুষকে উজ্জীবিত করে। একইসঙ্গে এর মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখা সম্ভব হয়। এ আয়োজন মানুষকে যে আনন্দ দিতে পেরেছে, নদীর দু তীরে দর্শক সমাগম তারই প্রমাণ।
নৌকা বাইচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে নদীর পাড়ে দৌঁড়তে দৌঁড়তে ছুটে আসছিল আট বছর বয়সী আল আমিন। ঘরের সবাই আগেই নদীর পাড়ে এসেছে। ওর আসতে একটু দেরি। আল আমীন জানালেন, নৌকা বাইচে অনেক মজা। গ্রামের এ উৎসব আয়োজনে খুবই ভালো লাগছে।
বেশ কদিন ধরে আলোচনায় থাকা নৌকা বাইচ শেষে মাইক নামে। ভাসমান দোকানগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই মানুষগুলো ছুটতে থাকে ঘরের দিকে। আবার ফাঁকা হয়ে যায় পাকুড়িয়া নদীর তীর। গ্রামবাসী অপেক্ষায় থাকবেন। আবার কবে কোন বিনোদনের খবর পান।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/আরআইএস