ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পাখিদের জন্য ওসির অনন্য ভালোবাসা

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৬
পাখিদের জন্য ওসির অনন্য ভালোবাসা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ধামরাই (ঢাকা) থেকে ফিরে: কিচির মিচির শব্দে মুখরিত গোটা এলাকাই। গাছে গাছে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি।

একটি দু’টি নয়, অসংখ্য। এর একটি থেকে মুখ বের করে দোয়েল যুগল পড়শীদের দিকে একটু তাকালো। তারপর উড়াল দিলো খাবারের সন্ধানে।

অন্য কোনো হাঁড়ির ওপরই নেচে-গেয়ে মহা আনন্দে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় চড়ুই পাখি। তারপর চলে দুষ্টুমি!

আবার অন্য হাঁড়িগুলোতে উড়ে এসেই কূজন শুরু করে শালিক, টিয়া, বুলবুলি, ঘুঘু ও শ্যামা-প্যাঁচাসহ কত শত পাখি!

হাঁড়ি তো নয়, যেন পাখির এক একটি ফ্ল্যাট বাসা! এমন অসংখ্য ঝুলন্ত ফ্ল্যাট বাসাই এখন ধামরাই থানা প্রাঙ্গনে।

পাখিপ্রেমি এক পুলিশ কর্মকর্তার বদৌলতে পক্ষীকূলের সদস্যরা বরাদ্দ পেয়েছে আধুনিক এসব ফ্ল্যাট বাড়ি!

তিনি শেখ মোহাম্মদ রিজাউল হক। ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। ডাক নাম দিপু। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সন্তান। বাবা মরহুম শেখ ইকরামুল হক। বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীর গ্রামের লোক। কিন্তু হাবভাবে নেই তার ন্যূনতম প্রকাশ। আছে বিনয় আর পেশাদারিত্ব। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছাপিয়ে এখন ছড়িয়ে গেছে প্রকৃতির অনন্য সম্পদ পাখির প্রতিও।

কালবৈশাখীসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাশ্রয়ী পাখিদের অনেকেই তাই দলবেঁধে ছুটে আসছে ওসির বানানো নতুন এই আবাসনে।

নতুন বাসিন্দা হয়েও যেন আনন্দের শেষ নেই পাখিদের। আর তাদের সেই ‘গানই’ এখন কূজন হয়ে কানে বাজে স্থানীয় বাসিন্দাদের।

যে কারণে ধীরে ধীরে থানার গাছপালা ঘিরে নতুন বসতি গড়েছে পাখিরা। এভাবেই এক একটি গাছ হয়ে উঠেছে পাখির অভয়ারণ্য।

থানায় ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল কড়ই, আম, জাম, পাকড়সহ নানা জাতের গাছ। ২৫টি গাছেই ঝুলছে অসংখ্য হাড়ি। দু’টি ডালের মাঝখানে কায়দা করে এমনভাবে  হাঁড়িগুলো বসানো হয়েছে, যেন বৃষ্টির পানি ভেতরে না যেতে পারে। আবার ঝড়-ঝঞ্জায় ছিঁটে-ফোটা পানি ঢুকে গেলেও যাতে পানি জমে না যায়, তা নিশ্চিত করতে ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে হাঁড়িগুলোতে।

যে কারণে দুর্যোগ-দূর্বিপাকেও পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এই ফ্ল্যাট বাসা!

জীববৈচিত্র্য রক্ষা। সেই সঙ্গে পাখি সুরক্ষায় তাদের নিরাপদ আশ্রয় গড়ার মতো ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের কারণ জানতেই ধামরাই থানার ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হকের বিনয়ী জবাব, ‘এ আর নতুন কি! আমি যেখানেই যাই সেখানেই ওদের জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করি’।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এর আগেও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া থানায় কর্মরত থাকার সুবাদে পাখির জন্য বিভিন্ন গাছে হাঁড়ি বেঁধেছি। অনেক প্রজাতির পাখি সেসব জায়গায় বাসা বেঁধেছে। বংশ বিস্তারও করেছে।

তিনি জানান, বেতনের টাকা বাঁচিয়েই বিশেষভাবে তৈরি প্রায় পাঁচশ’ মাটির হাঁড়ি কিনেছেন তিনি। প্রতিটি হাঁড়ির মূল্য ২০ টাকা।

মৃৎশিল্পীদের কাছে গিয়ে বিশেষায়িত হাঁড়ি তৈরির চাহিদার কথা বলেছেন। এ ধরনের হাঁড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিটি হাঁড়িতে দু’টি করে মুখ রয়েছে। একটিতে ঢোকা ও অন্যটি পাখির বের হয়ে যাওয়ার জন্যে। হাঁড়ির ভেতরটা অনায়াসে ঢোকা, বাসা বাঁধা, ডিম পাড়া এমনকি ‘তা’ দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর জন্যেও উপযোগী।

২০০০ ব্যাচের আউটসাইড এই ক্যাডেট বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পাখি। এক সময়ে পাখ-পাখালির দেশ বলে পরিচিত দেশটিতে দিন দিন বিপন্ন হয়ে পড়ছে পাখির আবাস। বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় আশ্রয়হীন হয়ে প্রজনন, ডিম পাড়া, তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর পরিবেশ হারাচ্ছে পাখিরা’।

‘আবার ঝড়-বৃষ্টিতে বাসা ভেঙে বা নষ্ট হয়েও আশ্রয়হীন হচ্ছে অনেক পাখি’।
‘এভাবে বিলুপ্তির পথে হরেক জাতের পাখি। অথচ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে কতোই না ভূমিকা রাখছে পাখিরা’।

‘প্রথমে এসব ভাবনা। পরে মমতা থেকেই উঠে এসেছে পাখিদের জন্যে এমন উদ্যোগ’- বলেন ওসি।

কেবল পাখিই নয়। নানা প্রজাতির দেশি মুরগিও পালন করছেন নিজ আঙিনায়। আর থানার পরিত্যক্ত পুকুর সংস্কার করে সেখানে করেছেন মাছের চাষ। যে পুকুরে প্যাঁক প্যাঁক করে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা প্রজাতির হাঁসেরাও।

এ ছাড়াও থানার পরিত্যক্ত আঙিনাকে নিজেই সাজিয়েছেন সবুজে। নিজের পরিশ্রমেই করেছেন মৌসুমী শাক-সবজির আবাদ।

ধামরাই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রকৃতি ও পাখির প্রতি পুলিশ কর্মকর্তার এই ভালোবাসা সত্যিই বিরল। এভাবে সবাই প্রকৃতিকে ভালোবাসলে প্রাকৃতিক সম্পদে আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতো দেশ’।

ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটা ওসির অনন্য মানবিক গুণাবলীর বহির্প্রকাশ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় থাকতেও পাখিদের জন্যে বাসা বানিয়ে প্রকৃতিপ্রেমিদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা’।

ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হকের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘যাদের এমন মানবিক গুণাবলী রয়েছে, কেবলমাত্র তাদের পক্ষেই সঠিক পুলিশি সেবা দেওয়া সম্ভব। কারণ যারা পাখিকে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারেন, তারা আরো বেশি ভালোবাসতে পারেন মানুষকে। তাদের মানবিক চরিত্রটিও অনেক উন্নত’।

পাখির কৃত্রিম এই বাসা তৈরির উদ্যোগ প্রকৃতির জন্যে অনন্য ভালোবাসা উল্লেখ করে ধামরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. খোরশেদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এভাবে সবাই যদি প্রকৃতি আর পরিবেশ নিয়ে সংবেদনশীল হতেন, তাহলে দেশটার চেহারাটাই বদলে যেতো’।

‘ধামরাই থানার ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হক আমাদের কাছে একটি আদর্শ। তিনি প্রকৃতির প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন’।

তিনি বলেন, ‘এভাবেই বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষা পাবে পাখি। জীববৈচিত্র্যে ভারসাম্য আনতেও এ উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে। কারণ, অপকারী কীট-পতঙ্গ খেয়ে পাখি বিষাক্ত  কীটনাশকের ব্যবহার কমাতেও ভূমিকা রাখছে’।

‘সর্বোপরি পাখি প্রকৃতির সৌন্দর্য। নিজ দায়িত্ব আর কর্তব্যের পরিধির বাইরে সৌন্দর্যকে বিকশিত করার মাধ্যমেই নিজের মানবিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করেছেন ধামরাই থানার ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হক’ বলেও মন্তব্য করেন ডা. খোরশেদ আলম।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৬
জেডআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।