গাবুরা (শ্যামনগর), সাতক্ষীরা থেকে: দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চারপাশ ঘিরে তিনটি নদী। পশ্চিমে খোলপেটুয়া নদীর ওপারে শ্যামনগরেরই আরেক ইউনিয়ন নীলডুমুর, দক্ষিণে খোলপেটুয়া ও কবোতাক নদীর ওপারে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন।
প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নদী আর বন থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় দ্বীপবাসীকে। ২০০৯ সালের মে মাসের প্রলয়ংকরী সিডরে ওয়াপদা বাঁধ উপচে গাবুরায় প্রবেশ করে খোলপেটুয়ার নোনা পানি। ধ্বংস হয়ে যায় ফসলি জমি আর আর্থিক ফলের বাগান। ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে এখন আয় বলতে চিংড়ির ঘের।
তবে চিংড়ির ঘের রয়েছে আয় উপজীবী ১০ শতাংশ মানুষের। বেশিরভাগেরই জীবিকা মাছ ধরা।
সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সুন্দরবন আর গাবুরার মাঝখানে দেড় কিলোমিটার প্রসস্ত খোলপেটুয়া নদীতে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা। সবগুলোতেই ড্রাম দিয়ে নেটের জাল ভাসানো।
নিষিদ্ধ এসব নেট জাল দিয়ে ধরা হচ্ছে নষ্ট চিংড়ির পোনা। নীল রংয়ের অতি সূক্ষ্ম এসব জালে সূঁচের মতো চিংড়ির পোনা ধরা পড়ে।
সরকার থেকে ২ মাসের জন্য নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ করলেও, পরিষ্কার দিনের আলোতে এভাবেই পোনা নিধন চলছে।
পঞ্চাশোর্ধ জেলে মনসুর আলী বলেন, পোনাও যদি ধরতে না পারি, তবে খাবো কি!
এক মৌসুমে বনে ঢুকতে চাইলে কম করেও ৫০ হাজার টাকা খরচ দিতে হয় ডাকাতদের। বিকাশে ডাকাতের দলকে টাকা দিয়ে আগেই যদি টোকেন পাওয়া যায় তবে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় ব্যবস্থা হয়। তবে টোকেন না নিয়ে গিয়ে ধরা খেলে ২০ হাজারের নিচে ছাড় পাওয়া যায় না। তাই ডাকাত দলগুলোকে টাকা দিয়েই বনে যেতে হয় জেলেদের।
জেলেরা নিজেরাও জানেন এভাবে পোনা ধরলে মাছের বিলুপ্তি ঘটবে। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি জালে যদি ৫ হাজার পোনা ধরা পড়ে, সেখান থেকে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ জীবিত পোনা পাওয়া যায়।
নয় নং সোরা গ্রামের শায়েফ মাঝি বলেন, জালই এখানকার জীবিকা। সরকার ২ মাসের জন্য জাল ফেলা নিষিদ্ধ করেছে। তাহলে এ দু'মাস সংসার চলবে কি করে! যেসব জেলের কার্ড রয়েছে তাদের সরকার থেকে এ দু’মাস অন্য ফসলের জন্য আর্থিক অনুদান দেয়ার কথা। তবে এখন পর্যন্ত এ টাকা কেউ পায়নি।
রহমত সিদ্দিক নামে পোনার বেপারি জেলেদের ধরে আনা পোনা বাছাই করছিলেন। কোন পাত্রের ওপর ওড়না বা গামছা দিয়ে তার ওপর পানিসহ পোনা ঢালা হয়। সেখান থেকে সাদা মেলামাইনের চামচ বা ঝিনুক দিয়ে পোনা বাছাই করা হয়। দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ পর্যন্ত পোনা ধরে আনেন জেলেরা।
রহমত জানান, বর্তমানে প্রতি হাজার পোনার দাম ১৮০০ টাকা।
ষাটোর্ধ্ব রইসুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, পূর্বে এখানে প্রচুর ধান চাষ হতো। ধানি জমি ছিল অনেক। ১৯৯৬ সালে গলদা চিংড়ির চাষ শুরু করেন কয়েকজন। তখন কেজি ছিল ১০০০ টাকা। তখনই সকলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গলদা চিংড়ি চাষে। বাঁধ কেটে ফসলি জমিতে লোনা পানি প্রবেশ করান। ধীরে ধীরে পুরো ইউনিয়ন লোনা পানিতে ভরে ওঠে। গাছপালা কমতে থাকে। আর আইলা এসে পুরো গাবুরাকেই লবণাক্ত করে দিয়ে যায়। এখন চিংড়ির কেজি নেমে এসেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে। অথচ লবণাক্ত পানির জন্য এখন খাবারের পানিও পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে জাল ফেলা বন্ধ করলে তাদের না খেয়ে থাকার উপক্রম হবে বলে জানান গাবুরাবাসী।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
এমএন/জেডএম