ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৭
বদলে যাচ্ছে গ্রাম বদলে যাচ্ছে গ্রাম/ছবি: বাংলানিউজ

কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে: শহর ছাড়িয়ে খানিকটা ভেতরে গেলে এখন আর গ্রামীণ ছমছমে ভাবের দেখা মেলে না। চারপাশে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগর। কমছে গ্রাম, ফসলের মাঠ, পদ্মপুকুর।

বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামগুলো সবার অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছে পালাবদলের প্রহরে প্রহরে। ছবির মতো সুন্দর, সাজানো, প্রাকৃতিক সবুজে-শ্যামলে ভরপুর ‘আমাদের গ্রামখানি’ পাওয়া তাই ক্রমে ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে।

শেষ শরতের উজ্জ্বল সকালে কিশোরগঞ্জ শহরের আশেপাশের গ্রামগুলোতে সরেজমিনে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র।

পৌর এলাকা ছাড়তেই শুরু সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়ন, যেখানে কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের কার্যালয়। একদা ‘শোলমারার মাঠ’ নামে পরিচিত জায়গাটিতে এখন বেশকিছু দালান-কোঠা, অপরিকল্পিত ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনা। পাশেই শহীদ স্মৃতিসৌধ। জায়গাটিকে গ্রাম নয়, গ্রাম-শহরের মিশেল বলে চিহ্নিত করা চলে।

খানিকটা এগিয়ে মহিনন্দ আর মাইজকাপন ইউনিয়নের সংযোগস্থল। মাইজকাপনের পর কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সীমানা শেষ।

একদিকে তাড়াইল আর অন্যদিকে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা এসে মিশেছে এখানে। পাকা রাস্তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দু’পাশে সঙ্কুচিত সবুজের দেখা মেলে। ক্রমেই কমছে ফসলের মাঠও। তা দখল করে তৈরি হয়েছে অনেক ইটের ভাটা আর কাঠের কল। কমছে গাছ-পালা, পরিবেশেরও বারোটা বাজছে।

ছিপ দিয়ে মাছ ধরা/ ছবি: বাংলানিউজ‘এলাকার অনেকেই বিদেশে থাকেন, কাঁচা টাকায় পাকা বাড়ি বানাচ্ছেন তারা। ফসলের ক্ষেত-বাগান কিনে বাসা-বাড়ি, মার্কেট তৈরি হচ্ছে। এজন্যই ইটের ভাটা ও স’মিলের এতো চাহিদা। জায়গার দামও হু হু করে বাড়ছে’- খিরোদা বাজারে বসে বলছিলেন রুবেল মিয়া।

ছোট ছোট গ্রাম্য বাজার এলাকায়ও এখন অনেক মার্কেট। আশেপাশে টিনের বাড়ির চেয়ে পাকা দালানই বেশি। গ্রামের হাট-বাজার বলতে যে উন্মুক্ত-খোলামেলা কেনা-বেচার পসরা, সেটিও আর নেই।

কয়েক মাইল পথ পার হয়েও তিন-চারটির বেশি পুকুরের দেখা মেলেনি। গ্রামের ভেতরের দিকে কিছু পুকুর থাকলেও বড় রাস্তার কাছাকাছি পুকুর বুজিয়ে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তবে ভেতরের দিকটাতে গ্রামীণ পরিবেশ কিছুটা বিদ্যমান এখনো। শরতের এ সময়টিতে গ্রামে গ্রামে কাঁচা পাট সংরক্ষণে ব্যস্ত চাষি, রাস্তার দু’পাশে পাটখড়ি ও গোবরের ঘুঁটে শুকানোর দৃশ্য তাই চোখে পড়েছে।

কোনো কোনো গ্রামে টিন-খড়ের ঘরই বেশি। কলাপাতা শুকিয়ে বাঁশের পাল্লায় পর্দার মতো টাঙ্গিয়ে রক্ষা করা হচ্ছে বাড়ির আব্রু। উদাম ছেলে-মেয়ে আর খালি শরীরের মানুষেরা দিব্যি গ্রামীণ পরিবেশের অঙ্গ হয়ে রয়েছেন। আর আছে চারপাশ ঘিরে থাকা দারিদ্র্যের অন্ধকার, অপুষ্টির ছাপ।

‘গ্রামের মানুষ মাছ ধরেন না, বাজার থেকেই কিনে খান’- বলেন রুবেল মিয়া। কিশোরগঞ্জ-তাড়াইল সড়কের পাশের এক নিভৃত গ্রামে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিলেন তিনি। পুঁটি আর কৈ ধরা পড়েছে কয়েকটি।

গ্রামের এ রূপান্তরে সুষ্ঠু পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। দালান-কোঠা, নানা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাকা রাস্তার আশেপাশে। সেখানে ধনবানরা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো নানা স্থাপনা গড়ছেন অপরিকল্পিতভাবে। গ্রামীণ কৃষিজমি প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে ফড়িয়া, দালাল বা উঠতি ধনী মানুষের হাতে। পরিবর্তিত হচ্ছে পেশাও। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে লাভজনক নানা পেশায় বা ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন অনেকেই।

তবে গ্রামকেই আধুনিক ও উন্নত করে গড়ার পক্ষে গ্রামের শিক্ষিত লোকজন। গ্রামকে গ্রাস করে শহর বানানোর নানা ক্ষতি নিয়ে আশঙ্কা তাদের।

নীলগঞ্জ বাজারে বসে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা ফিরোজ ভূঁইয়া তাই বলছিলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে গ্রাম বলে কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। সবাই আধুনিক হয়ে যাচ্ছেন। গ্রামীণ পোষাক, খাবার, পেশার কি হবে- সে ভাবনা কারো নেই’।

অবসরের পর গ্রামেই ফিরেছেন ফিরোজ ভূঁইয়া। একটি পাঠাগার গড়েছেন, সেটিই পরিচালনা করছেন।

ভেতরের দিকটাতে এখনো দেখা মেলে গ্রামীণ পরিবেশের/ ছবি: বাংলানিউজ‘উন্নয়নের নামে আসলে যা হচ্ছে, তা কিন্তু ক্ষণন্থায়ী’- বলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আহমদ হোসেন। চারদিকের পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত তিনিও।

তার প্রশ্ন, ‘লাভের জন্য সবাই বড় রাস্তা বা বাজারের দিকে চলে আসছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্য সুবিধাও এদিকেই বাড়ছে। ভেতরের গ্রামগুলো কিন্তু এখনো অন্ধকার। এভাবে অবহেলিত হলে গ্রাম টিকবে কি করে?’।

শেষ শরতের বিকেলের দিকে হেমন্তের টান তখন। ফিরতি পথেও চোখে পড়েছে ক্ষয়িষ্ণু সবুজ, বৃক্ষহীনতা। উদাসী মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় আমাদের গ্রামখানি’ মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে বাস্তবের জায়গা ছেড়ে স্মৃতির আঙিনায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৭
এমপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।