ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ডানায় শব্দ করে উড়ে যায় পরিযায়ী ‘রাজ-শরালি’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭
 ডানায় শব্দ করে উড়ে যায় পরিযায়ী ‘রাজ-শরালি’ বিলের জলে মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে রাজ শরালি

মৌলভীবাজার: এসে গেছে শীত। বাইক্কা বিলে আসতে শুরু করেছে নানা প্রজাতির হাঁস। দেখা মিলছে হাঁসদের মায়াবি উপস্থিতি। ঢেউ খেলে যাওয়া পানিতে হাঁসদের ক্রমাগত ডুব আর ডুব শুধু দৃষ্টির সৌন্দর্যই তুলে ধরে না; বাড়ায় বিলের সুস্বাস্থ্যের দিকটিও। চারদিক দিক থেকে হাজার হাজার হাঁস ঝাঁকে ঝাঁকে এই বিলের আশ্রয়প্রার্থী হয়।

আর বিলও এ সকল পরিযায়ীদের অনায়াসে বরণ করে নেয়। জলজ উদ্ভিদের ব্যাপক যোগান দিয়ে শোধ করে প্রাকৃতিক ঋণ।

যে শাপলাটি কিংবা পদ্ম বিলের পানিতে চোখ মেলে উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকায়, তার গায়েও হাঁসেদের লোমশ উচ্ছ্বাস এসে স্পর্শ করে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা হাঁসেদের ডানার বিরামহীন গতি জলজ উদ্ভিদের সর্বাঙ্গে প্রেরণা যোগায়। যেন অল্প দিনেই বেড়ে ওঠে তারা।  

বাইক্কা বিলের প্রাচীন অধিবাসী পরিযায়ী রাজ-শরালি। ইংরেজিতে এ হাঁসটিকে বলে Fulvous Whistling Duck এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna bicolour।

প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাজ-শরালির (Fulvous Whistling Duck) কথা লিখতে গেলেই পাতি-শরালির (Lesser Whistling Duck) কথা উঠবে; এ জন্য যে, লোকে যেন এ দুটো হাঁসকে আলাদা করে চিনতে পারেন। পাতি-শরালি আমাদের দেশে সারা বছরই থাকে এবং বিলে ছড়িয়ে থাকে। ধানক্ষেতের মধ্যে যেখানে যেখানে পানি আসে সেখানে তারা থাকে। তাড়া করলে ওরা গাছে উঠে যায়। ওরা পালিয়ে বাঁচতে পারে বলে ওরা এখনো টিকে আছে। শীতের সময় ধান ক্ষেতেও কোনো পানি থাকে না। তাই তখন ওরা বড় বড় বিল বা হাওরে চলে আসে। ’

বিলের কাদা জমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে রাজ শরালির ঝাঁক  ‘কিন্তু যে শরালিটা আমাদের দেশে থাকেই না এবং শীত মৌসুম এলেই সে আমাদের দেশে চলে আসে সে হলো রাজ-শরালি। পাতি-শরালি এবং রাজ-শরালি দেখতে অনেকখানি একরকম। তবে তফাৎ আছে। ওরা বসলে দেখা যায় যে, একটা আরেকটার থেকে বড়। রাজ-শরালি ৫১ সেন্টিমিটার এবং পাতি-শরালি ৪২ সেন্টিমিটার। এছাড়াও যেটি বোঝা যায় যে, ও বসলে ডানা যেখানে ভাজ হয় যেখানে অনেকগুলো সাদাটে পালক থাকে। পেটের উপরে উঠে আসে সেগুলো। গলায় কালো কালো লম্বা লম্বা দাগ থাকে। এই দাগ দেখেই বোঝা যায় যে এটা রাজ-শরালি’ বলে জানান ইনাম আল হক।  

তিনি আরো বলেন, ‘রাজ-শরালিরা এখন ঝাক বেঁধে সব বাইক্কা বিলে চলে এসেছে। পৃথিবীতে প্রায় চৌদ্দ-পনের প্রজাতির শরালি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে মাত্র ২ প্রকারের শরালি হাঁস দেখা যায়। এই শরালি হাঁস অন্য হাঁসেদের মতো নয়। অন্যদের থেকে এদের পার্থক্য হলে যে এদের ডানাগুলো এমনভাবে তৈরি যে উড়লেই ঝুনঝুন করে শব্দ হয়। শরালি উড়লেই আমরা অনেকেই মনে করি যে ওরা ডেকে ডেকে উড়ছে। আসলে ওইগুলো ডাক নয়। অন্য হাঁস উড়লে এমন শব্দ হয় না। ’

বিলের জলে মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে এক জোড়া রাজ শরালি অক্সিজেনের প্রসঙ্গে ইনাম আল হক বলেন, ‘একটা বড় ব্যাপার হলো রাজ-শরালি খুব ডুব দিতে পারে। বেশিভাগ হাঁসই কিন্তু ডুবে পানির একেবারে নিচে যেতে পারে না। রাজ-শরালিরা মাথা নিচু করে গলা টান করে পানির একেবারে নিচে চলে যেতে পারে। এই হাঁসেরা দলবেঁধে থাকে এবং বিলের পানিতে অক্সিজেন মেশায়। ফলে পানির নিচের গাছপালা ভালো থাকে; মাছও ভালো হয়। এই হাঁস যখন পানিতে ডুব দেয় তখন পানিতে অক্সিজেন চলে যায়। ’

‘এই তথ্য অনেকেই জানে না যে হাঁসেদের একটা বড় সেবা আছে আমাদের বিলের জন্যে এবং বিলের মাছের জন্যে। বিলের নিচের পানিতে যে জলজ উদ্ভিদ রয়েছে তাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিলের হাঁসেদের প্রযোজন। হাঁসের মল থেকেও অনেক সার পায় বিল। কারণ এটি নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার। ’বিলের জলে ভেসে বেড়ানো এক ঝাঁক রাজ শরালি  ‘ধরুন, আমাদের বাইক্কা বিলের কথা। এটি মাছের অভয়াশ্রম। এই বাইক্কা বিলে তো আমরা সার দিই না। তাহলে এই বিল কিভাবে পুষ্টি পায়? এই বিল হাঁসেদের বিষ্ঠা বা মল থেকেই পুষ্টি পায়। মনে করেন, বাইক্কা বিলে আজ যদি যান তবে কমপক্ষে ১০ হাজার নানান জাতের হাঁস দেখবেন। এখন ১০ হাজার হাঁসের যদি ৫০ গ্রাম করে মল পড়ছে তাহলে প্রায় ১ টন সার প্রতিদিন বিলে পড়ছে। শীত মৌসুমের চার মাস বা পাঁচ মাস অথবা যতদিন তারা থাকবে তখন দিন তারা এভাবেই বিলের এই উপকার করে যাবে। ’

এভাবেই আমাদের প্রতিদিন উপকার করে যাচ্ছে এবং তা অনেকেরই জানা নেই। হাঁস গুরুত্বপূর্ণ দুটো কাজ করে – নিচের পানিতে অক্সিজেন মেশায় এবং সার দেয়। ওরা পানির নরম উদ্ভিদ খায়। ওদের বেশির ভাগ খাবারই আমরা চোখে দেখতে পারি না। পানিতে মিশে থাকে এই জলজ উদ্ভিদকে ‘জুপরেনটন’ অথবা ‘ফাইটোপ্লানটন’ বলে। হাঁসেদের ঠোঁটটা তৈরি ওইভাবে। ওইগুলোই হাঁসেরা খায় বলে জানান পাখি বিজ্ঞানী ইনাম আল হক।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০৭ ঘণ্টা, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭
বিবিবি/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।