এতোদিন কেবল সবুজ অরণ্যে প্রকৃতির মায়াঘেরা নির্জন ছায়া বৃক্ষ আর পাখির কলতান শুনতে টিলাগড় ইকোপার্কে যেতেন পর্যটকরা। এবার সবুজ অরণ্যে খাঁচায় দেখা মিলবে বন্যপ্রাণীর।
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক থেকে সংগৃহীত ৫৭ প্রজাতির প্রাণী ও শ্রীমঙ্গল থেকে একটি অজগর এনে এই চিড়িয়াখানার জন্য সংরক্ষণ করেছে সিলেট বন বিভাগ।
এরই মধ্যে দু’টি জেব্রা (মাদি ও পুরুষ), দু’টি হরিণ, একটি অজগর, ১২টি ময়ূর, তিনটি ম্যাকাউ, মানুষের মতো কথা বলতে পারা আফ্রিকান গ্রে প্যারট চারটি, সেনকো কোনারি (এক প্রজাতির প্যারট) চারটি, সিলভার সিজেন্ট (বড় ধরনের ময়ুরের মতো পাখী) তিনটি, গোল্ডেন সিজেন একটি এবং ৩০টি লাভ বার্ড আনা হয়েছে।
আগামী শুক্রবার (০২ নভেম্বর) বিকেল ৪টায় চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রীর সহোদর জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আব্দুল মোমেন। তার সঙ্গে অতিথি হিসেবে থাকবেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) উপাচার্যসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সিলেটের প্রধান বন সংরক্ষক আর এস এম মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে এতথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কক্সবাজারের পর সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন সিলেটে। কিন্তু বিছানাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল ছাড়া শহর কেন্দ্রীক বিনোদন কেন্দ্রের কোনো স্থান নেই। আর বিভাগীয় শহর সিলেটে কোনো চিড়িয়াখানাও নেই। ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র সিলেটের টিলাগড় ইকোপার্ক এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি ‘মিনি’ চিড়িয়াখানা বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ‘মিনি’ চিড়িয়াখানায় রুপান্তর হওয়াতে এ অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদের বন্যপ্রাণী গবেষণার কাজেও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
উদ্বোধনের পর শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য টিকিটের দাম রাখা হয়েছে মাত্র ২ টাকা, অপ্রাপ্তদের জন্য ৫টাকা এবং প্রাপ্তদের জন্য টিকিট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা।
এই বন কর্মকর্তা বলেন, চিড়িয়াখানার জন্য বন বিভাগে অতিরিক্ত চিকিৎসক নেই। তাই কেন্দ্রীয়ভাবে চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে। এখন কেবল প্রাণী কিপার রয়েছেন একজন। যিনি প্রাণীদের দেখাশোনা করবেন। এছাড়া ডিসেম্বরে বাঘ-সিংহ আনার পাশাপাশি অ্যাকুরিয়াম করে বিভিন্ন জাতের রঙিন মাছ সাফারি পার্ক থেকে আনা হবে।
ইকোপার্কের জন্য ২০১৪ সালে বিদেশ থেকে আমদানি করা ওই পাখি ও প্রাণীগুলো এতদিন গাজীপুরের সাফারি পার্কে ছিল। পাখি ও অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীগুলো দর্শনার্থীদের দেখার জন্য বেস্টনির মধ্যে রাখা হয়েছে জানিয়েছেন টিলাগড় ইকোপার্কের ফরেস্টার চয়ন ব্রত চৌধুরী।
সিলেট শহর থেকে আট কিলোমিটর উত্তর-পূর্ব কোণে ২০০৬ সালে ছোট ছোট কয়েকটি টিলা সমৃদ্ধ ১১২ একর বন নিয়ে ইকো পার্কটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে উদ্ভিদ সম্পদের প্রাচুর্য্যতার পাশাপাশি রয়েছে একটি পাখি ও প্রাণীর বেষ্টনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সিলেটে তৃতীয় সরকারি বৃহত্তম চিড়িয়াখানা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এজন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। চিড়িয়াখানা নির্মাণে নগরীর টিলাগড়ের ইকোপার্কের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় ১১২ একর জমি।
চিড়িয়াখানাটি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়ার কথা থাকলেও বন বিভাগের আপত্তি থাকায় দীর্ঘদিন নির্মাণকাজ আটকে থাকে। পরবর্তীতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা থেকে বনবিভাগকে চিড়িয়াখানা নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বন বিভাগের অধীনে চিড়িয়াখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের মে মাসে। ২০১৬ সাল নাগাদ বরাদ্দকৃত প্রায় ১০ কোটির ছয় কোটি টাকায় গাছপালা ও টিলাঅক্ষত রেখেই বিভিন্ন প্রাণীর শেড নিমার্ণ করা হয়। দর্শনার্থীদের জন্য পাঁচটি আরসিসি বেঞ্চ, বিভিন্ন প্রাণীর শেড, শেডে যাওয়ার রাস্তা, চারটি সেন্ট্রি পোস্ট, পাঁচটি বক্র কালভার্ট, পানি সরবহরাহের শ্যালো টিউবওয়েল, স্টাফ ব্যারাক, সাইড ড্রেন, টিকিট কাউন্টার, পুকুর পুনঃখনন, ফিড অ্যান্ড ফুড প্রিজারভেশন, অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ সংযোগ, দর্শনার্থীদের জন্য গেস্ট হাউস, আহত উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীর জন্যে পুনর্বাসনকেন্দ্র ও হাসপাতাল তৈরি করা হয়।
ওই সময় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা হয় বাঘ, জেব্রা, ময়ূর, ভাল্লুক ও বিভিন্ন জাতের পাখিসহ ১৮টি প্রাণী। এই প্রাণীগুলো গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে রাখা হয়। প্রাণীগুলোর পেছনে খাবারসহ সব ব্যয়ভার বহন করে সিলেট। এরপরও বন্যপ্রাণী কেনার বাকি চার কোটি টাকা ফেরত যায়। অবশেষে আলোর মুখ দেখলো দেশের তৃতীয় চিড়িয়াখানা সিলেটের টিলাগড় ইকোপার্ক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৮
এনইউ/আরএ